Advertisement
১৯ মে ২০২৪
Adenovirus

আতঙ্ক উস্কে ফের মৃত ছয়

এখনও পর্যন্ত ৫২১৩ জন শিশু অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে অ্যাডিনোভাইরসে আক্রান্ত হয়ে।

picture of child death.

মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে বুধবার পর্যন্ত রাজ্যে আরও ছয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে। প্রতীকী ছবি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০২৩ ০৫:৩২
Share: Save:

জ্বর ও শ্বাসকষ্ট-সহ অসুখে আক্রান্ত হয়ে একের পর এক শিশুর মৃত্যু এ বার গভীর চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে রাজ্য জুড়ে। অভিভাবকদের মধ্যে যেমন আশঙ্কা বাড়ছে, তেমনই উদ্বিগ্ন রাজ্য প্রশাসনও। মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে বুধবার পর্যন্ত রাজ্যে আরও ছয় শিশুর মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে বি সি রায় শিশু হাসপাতালে তিন জন, কলকাতা মেডিক্যালে দু’জন এবং উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে এক জন চিকিৎসাধীন ছিল। পরিসংখ্যান বলছে, সোমবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত শ্বাসকষ্টের জেরে ১৪ জন শিশুর মৃত্যুর সাক্ষী থাকল রাজ্য।

এ দিন রাজ্য সরকারের তরফে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এখনও পর্যন্ত ৫২১৩ জন শিশু অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে অ্যাডিনোভাইরসে আক্রান্ত হয়ে। তাদের মধ্যে ৮ জনের কো-মর্বিডিটি ছিল। অথচ অ্যাডিনোভাইরাস না কি অন্য কোনও ভাইরাসে রোগী আক্রান্ত, তা চিহ্নিত করার জন্য রাজ্যের সর্বত্র ভাইরাল প্যানেল পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। একমাত্র কলকাতায় স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন (এসটিএম) ও নাইসেডে সরকারি স্তরে ওই পরীক্ষা হয়। আর বেসরকারিতে পরীক্ষার খরচ কয়েক হাজার টাকা।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য দফতর নির্দেশিকা জারি করে জানিয়েছিল, অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইনফেকশন বা শ্বাসযন্ত্রে মারাত্মক রকমের সংক্রমণ রয়েছে, এমন শিশুদের নমুনা পরীক্ষার জন্য এসটিএম ও নাইসেডে পাঠাতে হবে। সূত্রের খবর, এসটিএমে ভাইরাল প্যানেল পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত কিট নেই। যেখানে রাজ্যে প্রায় প্রতিদিনই বহু শিশু আক্রান্ত হচ্ছে, একের পর এক শিশু মারা যাচ্ছে, সেখানে এসটিএমে এমন হাল কেন?

কর্তৃপক্ষের দাবি, “নির্দিষ্ট সংখ্যক কিছু পরীক্ষা হচ্ছে। কিটের জন্য বরাত দেওয়া হয়েছে। ভোপাল থেকে আসতে একটু সময় লাগছে। তবে আশা করা যায়, বৃহস্পতি বা শুক্রবারের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।” একই রকম ভাবে দুই দিনাজপুর ও মালদহেও সরকারি স্তরে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। এ দিকে রায়গঞ্জ মেডিক্যাল, বালুরঘাট জেলা হাসপাতাল, গঙ্গারামপুর মহকুমা হাসপাতাল ও মালদহ মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন শিশুর সংখ্যা বাড়ছে।

স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, “অ্যাডিনো না অন্য কিছু সেটা পরীক্ষা করা বড় বিষয় নয়। শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত শিশুকে কী ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হবে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে স্থানীয় স্তরের হাসপাতালে প্রাথমিক ব্যবস্থাপনায় দেরি হয়েই রোগীর অবস্থা জটিল হচ্ছে।” জেলা স্তরের হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (পিকু) নেই। কিন্তু সেখানে বড়দের চিকিৎসায় যে সিসিইউ বা এইচডিইউ রয়েছে, সেই পরিকাঠামো ও মেডিক্যাল অফিসারদের দিয়েই শিশুদের সঙ্কটজনক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কথা বলেছে স্বাস্থ্য দফতর।

জেলা স্তরের হাসপাতালের শিশু রোগ চিকিৎসক, সিসিইউ বা এইচডিইউ-র মেডিক্যাল অফিসারদের নিয়ে কর্মশালায় আর জি করের ক্রিটিক্যাল কেয়ারের প্রধান চিকিৎসক সুগত দাশগুপ্ত ও কলকাতা মেডিক্যালের পিকুর প্রধান চিকিৎসক মিহির সরকার জানান, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত শিশুকে অক্সিজেন, বাইপ্যাপ বা সিপ্যাপের মতো নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন পর্যন্ত চিকিৎসা দিতে আলাদা করে পিকুর দরকার নেই। বড়দের পরিকাঠামোতেই শিশুদের মতো মাস্ক, ক্যানুলা ও সার্কিট ব্যবহার করে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব। দু’জনের কথায়, “এমন ব্যবস্থাপনা চালু থাকলে বাচ্চাকে স্থানীয় স্তরেই চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা সম্ভব।”

মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে এ দিন সকাল পর্যন্ত যে ছ’জনের মৃত্যু হয়েছে তার মধ্যে তিন জন অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত ছিল। বাকি তিন জন কোন ভাইরাসে আক্রান্ত, তা জানা না গেলেও তাদের শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণের ফলে শ্বাসকষ্ট ছিল। মঙ্গলবার উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে সিভিয়র রেসপিরেটরি ফেলিয়োরে মারা গিয়েছে উত্তর দিনাজপুরের চোপরার ১৯ দিনের এক নবজাতক। ওই হাসপাতালের সুপার সঞ্জয় মল্লিকের দাবি, ‘‘জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে কোনও শিশু এখানে মারা যায়নি। ওই সদ্যোজাতের কী কারণে মৃত্যু হল, তা দেখতে হবে।’’ গোবরডাঙার বাসিন্দা চার বছরের এক শিশুকে জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় হাসপাতাল থেকে কলকাতায় আনা হয়। পরিজনের দাবি, সারা শহর ঘুরেও পিকুতে ঠাঁই মেলেনি। শেষে বি সি রায় হাসপাতালে সাধারণ শয্যাতেই ভর্তি করে ভেন্টিলেশন দেওয়া হয়। বুধবার সকালে পিকুতে স্থানান্তরিত করা হলেও শিশুটির মৃত্যু হয়। ক্যানিংয়ের বাসিন্দা এক বছর তিন মাসের শিশুকে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় হাসপাতাল থেকে বি সি রায়ে নিয়ে আসা হয়। পরের দিনই তাকে পিকুতে পাঠাতে হয়। এ দিন সকালে তার মৃত্যু হয়েছে। পরিজন জানাচ্ছেন, চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন শিশু অ্যাডিনোতে আক্রান্ত ছিল। দেগঙ্গার ন’মাসের শিশুর অভিভাবকের দাবি, জ্বর নিয়ে আগে বি সি রায়ে আসার পরে বহির্বিভাগে দেখে বাড়ি পাঠানো হয়। তার পরে ভর্তি করতে হয় বারাসত হাসপাতালে। সেখানে দিন কয়েক থাকার পরে পরিস্থিতি সঙ্কটজনক হওয়ায় আনা হয় বি সি রায়ে। তার পরে এ দিন রাতে মৃত্যু।

হুগলির হামিদপুরের সাত মাসের শিশু এবং বাগনানের ২২ দিনের একরত্তি সঙ্কটজনক অবস্থায় ভর্তি ছিল কলকাতা মেডিক্যালে। হৃদ্‌যন্ত্রে জন্মগত সমস্যাও ছিল তাদের। এ দিন ভোরে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

শহরের ওই দুই হাসপাতালের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে এ দিন সেখানে যান স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম। এ দিনই কলকাতা মেডিক্যালে আরও ৫০টি এবং বি সি রায়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসে ২২টি শয্যা (৭২টির মধ্যে ৫০টি চালু ছিল) বাড়ানো হয়। বেসরকারি সূত্রের খবর, গত ১ জানুয়ারি থেকে এ দিন পর্যন্ত রাজ্যে এ ভাবে মোট মারা যাওয়া শিশুর সংখ্যা ৪৭। তার মধ্যে বি সি রায়ে ১৯, কলকাতা মেডিক্যালে ১৬, বাঁকুড়া মেডিক্যালে ২, বর্ধমান মেডিক্যালে ২, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে ১, ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথে ৫ এবং পিয়ারলেস হাসপাতালে ২ জন।

এ দিন কোচবিহারে বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, “শিশুমৃত্যু আটকাতে কোনও প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি।... কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনে তাদের নিয়ে এসে শিশু-মৃত্যু আটকানো প্রয়োজন।” গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদক কনীনিকা ঘোষের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীই স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।” বহরমপুরে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর অভিযোগ, “হাসপাতালে শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, মৃত্যু বাড়ছে। সরকার তথ্য গোপন করছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Adenovirus child Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE