পাঁচ বছর আগে বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল হাওড়ার শালিমার পেন্টস। সেই ঘটনার পরে রাজ্য সরকারের শত চেষ্টা সত্ত্বেও সেই কারখানা পুরোদস্তুর চালু করা যায়নি। যার ফলে হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন শতাধিক কর্মী। পাঁচ বছর ধরে প্রবল অর্থকষ্টে ভোগার পরেও সেই কারখানায় পুনর্বহাল হওয়ার কোনও সম্ভাবনা না দেখে শেষমেশ সোমবার সকাল থেকে সেখানকার ৭০ জন কর্মী তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বসে পড়েন কারখানার গেটের সামনে। দাবি, হয় টাকা দেওয়া হোক, নয়তো চাকরি। এ ব্যাপারে কারখানা কর্তৃপক্ষের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। কারখানার ভিতরেও কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি এ দিন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ১০০ বছর পেরোনো ওই কারখানার কর্মীরা কাজ তো হারিয়েছেনই, কারখানার কাছেই যে আবাসনে তাঁরা থাকতেন, সেই বাসস্থানটুকু ছাড়া সবই চলে গিয়েছে। কর্মীদের অভিযোগ, এত বছর চাকরি করার পরে বকেয়া বেতন তো দূর, পিএফ ও গ্র্যাচুইটির টাকাও পাননি তাঁরা। ফলে পরিবার প্রতিপালনের জন্য যে যা পারছেন, করছেন। অভাবের তাড়নায় টোটো ভাড়া নিয়ে চালাচ্ছেন আবদুল ইব্রাহিম। বাজারে আনাজ বিক্রি করছেন মহম্মদ আয়ুব। রাস্তার ধারে বসে ভিক্ষা করছেন মানিক মজুমদার। কাজ চলে যাওয়ার পরে আর্থিক কারণে কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন শেখ হাতেম। এ দিন সকাল থেকে ধর্নায় বসেছেন তাঁর বিধবা স্ত্রী আজমিরা বেগমও। তিনি বলেন, “১৪ বছরের ছেলের পড়াশোনাই বন্ধ হতে বসেছে। মেয়ে লোকের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করে। আমি সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালাই।’’
মাত্র আট মাস আগে স্বামীকে হারিয়েছেন কুরেশা বেগম। তিনি বলেন, “কারখানা কবে পুরোপুরি খুলবে, সেই ভাবনাই সারা ক্ষণ কুরে কুরে খেত আমার স্বামী জামালউদ্দিন খানকে। মারা যাওয়ার আগে সব সময়েই প্রলাপের মতো ‘কারখানা খুলছে, কারখানা খুলছে, কাজে যাব’ বলে চলতেন। এখন ছেলে ভ্যানরিকশা চালিয়ে যা রোজগার করে, তাতেই দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের সংস্থান হয়।’’
২০১৪ সালের মার্চ মাসে বিধ্বংসী আগুন লাগে হাওড়ার নাজিরগঞ্জের শালিমার পেন্টসের কারখানায়। তার পরেই শতাধিক কর্মীর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। ২০১৭ সালের মার্চে কারখানা কর্তৃপক্ষ, রাজ্য সরকার ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হয়। যার উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, সাত দিনের মধ্যে কারখানা চালু করা হবে এবং প্রথমেই ২০ জনকে কাজে নেওয়া হবে। তার পরে তিন মাসের মধ্যে সমস্ত কর্মী কাজে যোগ দেবেন। এ দিন কারখানার গেটে বিক্ষোভকারী কর্মীদের অভিযোগ, ওই বৈঠকের ছ’মাস পরে মাত্র সাত জন কর্মীকে পুনরায় কাজে বহাল করা হয়। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত আর কোনও কর্মীকে কাজে নেওয়া হয়নি। তাঁদের অভিযোগ, ইতিমধ্যেই অর্থাভাবে কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন ১৪ জন শ্রমিক। অবসরের বয়স পেরিয়ে গিয়েছে ৫০ জনের।
কর্মীদের ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক সুকুমার দেবনাথ বলেন, ‘‘কারখানা কর্তৃপক্ষ আমাদের ভাঁওতা দিয়ে চলেছেন। রাতের অন্ধকারে উৎপাদন করে মাল সরবরাহ করা হচ্ছে। আমরা চাই, হয় কারখানা পুরোপুরি খুলে কর্মীদের কাজে নেওয়া হোক, না হলে আমাদের বকেয়া টাকা দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হোক।’’ কর্মীরা জানান, তাঁদের দাবি না মানা পর্যন্ত এই অবস্থান বিক্ষোভ চলবে। এ দিন নানা ভাবে চেষ্টা করা হলেও কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।