Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

তিরাশির বৃদ্ধ আটত্রিশের যযাতি হয়ে ভ্যানিশ

জাদুকরেরা মঞ্চে অনায়াসে বেড়ালকে রুমাল আর রুমালকে বেড়াল করে দিতে পারেন। কিন্তু এক হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় যিনি ৮৩ বছরের বৃদ্ধ ছিলেন, অন্য হাসপাতালে পৌঁছনোর পরে তিনিই কী ভাবে ৩৮ বছরের যুবক হয়ে যেতে পারেন, সেটা একটা প্রহেলিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ১৭:১৮
Share: Save:

জাদুকরেরা মঞ্চে অনায়াসে বেড়ালকে রুমাল আর রুমালকে বেড়াল করে দিতে পারেন।

কিন্তু এক হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় যিনি ৮৩ বছরের বৃদ্ধ ছিলেন, অন্য হাসপাতালে পৌঁছনোর পরে তিনিই কী ভাবে ৩৮ বছরের যুবক হয়ে যেতে পারেন, সেটা একটা প্রহেলিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কী করে এমনটা হতে পারে, বলতে পারছেন না কেউ। অথচ আপাতদৃষ্টিতে তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছে উত্তরবঙ্গে। ঘটনা, নাকি ঘটনা-ভ্রম, তার নিরসন হয়নি।

যুক্তি-বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা মিলছে না বলেই ভুলভ্রান্তির সম্ভাবনার কথা উঠছে। বয়স লেখার সময়ে কি কোনও বিভ্রাট হয়েছে? সদুত্তর মিলছে না। বিস্ময়কর ব্যাপার হল, শুধু অভাবিত শারীরিক বিবর্তনই নয়। বেমালুম বদলে গিয়েছে সেই ব্যক্তির পদবিও। সেটাও কি লেখার ভুলেই ঘটে গিয়েছে? তারও উত্তর নেই।

এই অবস্থায় শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে ভর্তি থাকা ৮৩ বছরের কালু মাঝি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পৌঁছে ৩৮ বছরের কালু নাথ হয়ে গেলেন, তা নিয়ে বিভ্রান্তি অব্যাহত। অকালবৃদ্ধ যযাতি ফের যুবক হতে পেরেছিলেন পুত্র পুরুর দান করা যৌবনে ভর করে। কিন্তু সেই বিবর্তনের পরে যযাতির পদবি বদলে গিয়েছিল, এমন কথা বলে না মহাভারতও। কালুর ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে কালু নাথ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরে। বিষয়টি গড়িয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট পর্যন্ত।

কোথাও কারও ভুল হয়ে থাকলে এই ধোঁয়াশা কাটানো সহজ হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট দুই হাসপাতালের কেউ ভুল কবুল করেননি। কালু প্রথমে যেখানে ভর্তি ছিলেন, সেই শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালের সুপার জানাচ্ছেন, তাঁরা এক বৃদ্ধকেই পাঠিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে। আর কালুকে যে-হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল, সেই মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সুপার জানান, তাঁরা এক যুবককে পেয়েছিলেন। সেই যুবক পরের দিনই পালিয়ে যান। তাঁকে পাওয়া গেলে রহস্যের কিনারা হতে পারত। কিন্তু সেই উপায়ও নেই।

ঠিক কী ঘটেছিল?

গত ৫ এপ্রিল এক বৃদ্ধকে নিউ জলপাইগুড়ির স্টেশনের কাছে একটি নালায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর বাঁ হাত ভাঙা ছিল। এক দল যুবক ওই আহত অসহায় বৃদ্ধকে ভর্তি করিয়ে দেন শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে। উদ্ধারকারী যুবকদের নেতা, শিলিগুড়ির বাসিন্দা অমিত সরকার জানান, সামান্য সুস্থ হয়ে সেই বৃদ্ধ নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন ‘কালু মাঝি’ বলে। জানিয়েছিলেন, তাঁর বয়স প্রায় ৮৩ বছর। বাড়ি বিহারের বক্তিয়ারপুরে। অমিতবাবু বলেন, ‘‘আমরা বিহারে যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু বৃদ্ধের দেওয়া ঠিকানায় কাউকেই পাওয়া যায়নি।’’

ওই যুবকেরা জানান, শিলিগুড়ির জেলা হাসপাতালে ভালই ছিলেন বৃদ্ধ। আস্তে আস্তে খেতে শুরু করেন। দুর্বল শরীরে জোর আসতে শুরু করে। ঠিক হয়, বাঁ হাতে অস্ত্রোপচার করা হবে। সেই জন্য তাঁকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার কথাও হয়। প্রমল বণিক নামে ওই যুবকদের এক জন নিজের নাম-ঠিকানা দিয়ে ওই বৃদ্ধকে শিলিগুড়ি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। তিনি ১৫ এপ্রিল ওই হাসপাতালে বৃদ্ধকে দেখতে গিয়ে জানতে পারেন, তাঁকে ১১ এপ্রিল স্থানান্তরিত করা হয়েছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে। প্রমলেরা ছোটেন সেখানে। কিন্তু সেই হাসপাতালে গিয়ে বৃদ্ধ কালু মাঝিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কালু নাথ নামে এক যুবক ১১ তারিখে শিলিগুড়ির হাসপাতাল থেকে এসে মেডিক্যালে ভর্তি হন। ১২ তারিখের পর থেকে তিনি বেপাত্তা। এই কালু নাথের ঠিকানা ও অভিভাবকের জায়গায় প্রমলেরই নাম লেখা!

কী করে এমনটা হল?

শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালের সুপার অভিজিৎ মণ্ডল বলেন, ‘‘আমরা যাঁকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়েছিলাম, তাঁর নাম ছিল কালু মাঝি। বয়স ৮৩ বছর। এই সংক্রান্ত নথি আমাদের কাছে আছে।’’

আর উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের সুপার সব্যসাচী দাস বলেন, ‘‘কালু মাঝি নামে কেউ আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হননি। কালু নাথ নামে এক জন ভর্তি হয়েছিলেন। তবে তাঁর বয়স ৩৮ বছর।’’

এমন তো হতেই পারে যে, ভুলবশত বয়স ও পদবি ভুল লেখা হয়েছে। তেমনই কিছু হয়েছে কি?

প্রশ্ন শুনে সব্যসাচীবাবু বলেন, ‘‘আমাদের হাসপাতালে যাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল, তিনি বৃদ্ধ নন, যুবক। বৃদ্ধ ও যুবকের তফাতটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার কর্মীদের রয়েছে।’’

অমিতবাবুদের প্রশ্ন, শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে চেপে আধ ঘণ্টা দূরের উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে যাওয়ার পথে কী করে একটি লোকের নাম আর বয়স দু’টিই আচমকা বদলে গেল? এক বৃদ্ধ আধ ঘণ্টার রাস্তা পেরোনোর সময়টুকুতে কী ভাবে যুবক হয়ে যেতে পারেন? পুলিশ-প্রশাসন, হাসপাতাল ঘুরেও বৃদ্ধের অন্তর্ধানের পিছনে কোনও গ্রহণযোগ্য কারণ খুঁজে না-পেয়ে চলতি মাসে তাঁরা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। তাঁদের আবেদন, ওই বৃদ্ধকে খুঁজে বার করে আদালতে আনার জন্য (‘হেবিয়াস কর্পাস’) পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হোক।

শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা জানান, তদন্ত চলছে। তাঁর কথায়, ‘‘শিলিগুড়ির জেলা হাসপাতাল থেকে ওই বৃদ্ধকে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। তার পর থেকেই তিনি নিখোঁজ। কিছু তথ্য জোগাড়ের প্রক্রিয়া চলছে।’’

প্রহেলিকার ফেনা সরালে এটুকুই পড়ে থাকে যে, বৃদ্ধ কালু মাঝি নিখোঁজ আর যুবক কালু নাথও উধাও। কিন্তু কী করে দু’-দু’টি মানুষ এ ভাবে অন্তর্হিত হয়ে গেলেন?

গোটা ঘটনার মধ্যে অন্য এক রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন অমিতবাবুরা। শিলিগুড়ি থানায় কালু মাঝির নিরুদ্দেশ হওয়ার লিখিত অভিযোগ করার সময় তাঁরা তাই মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে ব্যবসায় জড়িত দুষ্টচক্রের কথাও উল্লেখ করেছেন। অভিযোগ, মাঝেমধ্যেই এই ধরনের অজ্ঞাতকুলশীল মানুষ এসে শিলিগুড়ির বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। আর কিছু দিনের মধ্যেই তাঁদের নাম নিখোঁজের তালিকায় ঢুকে পড়ে। এমন ঘটনা যে ওই অঞ্চলে আকছার ঘটে, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের সুপার সব্যসাচীবাবুর বক্তব্যে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তিনি জানান, তাঁর হাসপাতাল থেকে প্রতি মাসে গড়ে ২-৩ জন নিখোঁজ হয়ে যান।

নিখোঁজ হয়ে কোথায় যান তাঁরা?

অমিতবাবুদের সন্দেহ অনুযায়ী অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবসার বিষয়টি সত্যি হলে ব্যাপারটা আর মোটেই বেড়াল-রুমাল খেলার মতো হাল্কা থাকে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

old age man sunanda ghosh siliguri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE