Advertisement
E-Paper

লাইটে শিবঠাকুর, মঞ্চে নাগকন্যে

বাসুকিকে গলায় ধারণ না-ই বা করলেন! তিনি যেন সাক্ষাৎ নাগেশ্বর। দশ বাই বারো ফুটের খোপ! লোহার শিকঘেরা। ভিতরে কিলবিল হলুদ-কালো ডোরাকাটা শাঁখামুটি, পুরুষ্টু চন্দ্রবোড়া, কালাচ, গোখরো! বিষহীন লাউডগা, বালিবোড়া বা চন্দন-সিঁদুর-কাজলে অপরূপ কালনাগিনীরা ফোল্ডিং টেবিলে।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:২০

বাসুকিকে গলায় ধারণ না-ই বা করলেন! তিনি যেন সাক্ষাৎ নাগেশ্বর।

দশ বাই বারো ফুটের খোপ! লোহার শিকঘেরা। ভিতরে কিলবিল হলুদ-কালো ডোরাকাটা শাঁখামুটি, পুরুষ্টু চন্দ্রবোড়া, কালাচ, গোখরো! বিষহীন লাউডগা, বালিবোড়া বা চন্দন-সিঁদুর-কাজলে অপরূপ কালনাগিনীরা ফোল্ডিং টেবিলে।

পাড়াগাঁয়ের এক বুড়িমা কত রাতে শো শেষ হওয়া অবধি হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। বাবা তুমিই শিবঠাকুর। রানাঘাট লাইনের বগুলা থেকে টাটার বিষ্টুপুর, কলকাতা থেকে জামতাড়া-চিত্তরঞ্জন, এক বাক্যে এটাই বলত বটে! চোঙায় ফুঁ দিতেই, পিলপিল করে লোক ঢুকত টেন্টে। ‘‘আসুন, আসুন সাপের ঘরে জ্যান্ত মানুষ! মিলনকুমারের বিষধর সাপের প্রদর্শনী তখন হট ক্রেজ।’’ ‘ফটিকচাঁদ’-এর সময় সাপের বাক্স হাতে সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি অবধি গিয়েছিলেন মিলন।

এখন সময়ান্তরে জ্যান্ত সাপের বদলে জলজ্যান্ত নাগকন্যাকে নিয়ে সংসার! হিন্দি বইয়ে যাকে বলে, ইচ্ছাধারী নাগিন। শিবঠাকুর ‘মামা’ হয়েছেন। নাগকন্যের মামা। বছর চোদ্দো পার করেও মেয়ে এক্কেবারে ছেলেমানুষ! খেলায় লোক না-হলে টেন্টের ফাঁক দিয়ে জুলজুল চোখে বাইরে তাকিয়ে থাকে। নাগরদোলার চরকি পাকের ঘরঘর ডাকটাই তখন সাপুড়ের বাঁশি! মেয়ে বলে, ‘‘মামা আজ রাতে কিন্তু ফুচকা খাব!’’ ভরসন্ধের শোয়ের টাইমে এই সাপিনীকে কি মেলায় বের করা যায়? ঘরে ঘরে ভিডিও গেমের যুগে মাঠ ভাড়া যিনি দিয়েছেন, টিকিটপিছু ৩০-৩৫% ভাগ তিনি পাবেন। ‘‘বড্ড হাই রেট! তবু লড়ছি!’’ সগর্বে বলেন মিলন। ‘‘একটা ইয়ং মেয়েকে যার-তার কাছে ভরসা করে কি ছাড়বে বাড়ির লোক? আমি ফ্যামিলিম্যান মশাই! ৪০ বছর মেলার লাইনে থেকে নিজের দু’টো মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।’’

তাঁবুর হেঁসেলের চাবি যার আঁচলে, সেই ছায়াদি মানে ছায়া ভুঁইয়ার সঙ্গেই ভাব হয়েছিল আসানসোলের উখড়ার আজমিনা বিবির। বিবির স্বামী আশ মহম্মদ শেখ কেরলে দিনমজুর। এইট পাশ মেয়েটার পড়াশোনা আর টানতে পারছিলেন না তাঁরা। ছায়া-ই বোঝান আজমিনাকে, মাস গেলে যা হোক টাকাও তো আসবে। মেয়েটা লাফিয়ে ওঠে। মেলায় মেলায় ঘুরব। প্যান্ডেল দেখব, ফুচকা খাব!

নাম তার আসমাতারা খাতুন। টেন্টের ইচ্ছাধারী নাগিন!

‘‘সাপের খেলার একটাই নিয়ম! মানে ওর মুখ আর আপনার চোখ সমানে-সমানে চলবে!’’ দ্বিপ্রাহরিক আয়েসে লুঙ্গি সামান্য গুটিয়ে হাঁটুর কাছটায় হাত বুলোন মিলনদা। পা-ভর্তি সাপের কামড়ের দাগ। শাড়ির পাড় বা হাল্কা রবারের নলে বাঁধলে সব থেকে ভাল। শিরা বাদ দিয়ে কেটেকুটে বিষরক্ত বের করে দাও। পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দিয়ে ক্ষতস্থান ধুয়ে ফেল। পরের দিন ইঞ্জেকশন। মিলন হাসেন, ‘‘এমনিতে ভিতু অবলা! শুধু বর্ষার মেটিং সিজনটা যা অস্থির।’’

এখনকার খেলা যন্ত্রনির্ভর। প্রোজেক্টর মেশিন গড়বড় করল কি আলোর ডিমারে ভোল্টেজ বেড়ে গেল, জমবে না! মেয়েটা তো স্রেফ দু’হাত তুলে দাঁড়াবে টেন্টের কেবিনে। তার সামনেই অন্ধকারে একটা ইয়া ফণাওয়ালা ফাইবারের গোখরো লুকিয়ে। সে দিনের শিবঠাকুর উঁচু টুলে বসে ডিমার তাক করবেন। ‘‘আস্তে আস্তে লাইট বাড়িয়ে-কমিয়ে মেয়েটার সঙ্গে সাপটার বডি টু বডি শ্যাডো মিলিয়ে যেতে হবে।’’ আস্তে আস্তে মেয়ে ফেড আউট করে ফণাধারী ফেড ইন। অ্যাসিস্ট্যান্ট লগা বা পচা কেবিনের ভিতর থেকে সাপ নাড়ায়। সিটি-হাততালিতে ভরে ওঠে তাঁবু।

‘‘আর কীই বা করতাম! মানেকা গাঁধী বন্যপ্রাণী নিয়ে কী একটা আইন করলেন!’’ ১৪ রকমের ছোট-বড় সাপ। ১০০-রও বেশি। সব গুনে গুনে বন দফতরে জমা দিয়ে এসেছিলেন। খসখসে গলা হিসহিসিয়ে ওঠে, সাপের খেলা বন্ধ হয়েছে, দুঃখ নেই। কিন্তু খামোখা সাপ মারা তো বন্ধ হল না। দাঁড়াশের ল্যাজের ছোঁয়ায় শরীর খসে যায় না। সাপ গরুর বাঁট থেকে দুধ খায় না। কালনাগিনীর বিষ নেই। এ সব তখন পাবলিককে বোঝাতাম। কী হবে তার? এক পুজোতেই ভাবতে ভাবতে কুলটি না মেচোগ্রামে নাগকন্যার ইচ্ছাধারী নাগিনের আইডিয়া বের হল। সঙ্গে জুড়ল কঙ্কাল। ‘‘মেল্টিং ম্যান বলে একটা বই দেখেছিলাম, হরর পিকচার। তাতে লোকটার রক্তমাংসমজ্জা গলে কঙ্কাল হয়ে যাচ্ছে।’’ নাগিনের বিণ বদলে তখন ভূতের বই নাইন্টিন টোয়েন্টি-র ডায়লগ বাজে, ‘তু ইস বচ্চি কে শরীর মে কিঁউ আয়ী হো’! জামালপুরের ঝুলনমেলা, গড়বেতার গণেশমেলা, ডানকুনির ইদের মেলা বা কোম্পানিবাগানের দুগ্‌গো পুজোর মেলা— তাঁবুর আড়ালে এটাই জীবন। খেলা শুরুর আগে দিদির কাছে বেড়াতে আসা ছোট ভাই আহমেদ হাসে, হ্যাঁ রে, তুই দিদি না সাপ রে!

ক্লান্তি মেখে ভোর রাতে শো ভাঙলে কদাচিৎ সস্তার হুইস্কিতে চুমুক দেন মিলন। খুদে নাগিন তত ক্ষণে চাটাইতে ঘুমিয়ে কাদা। আর তো ক’টা দিন, একটু সয়ে নে! একাদশী পড়লেই তোকে ঠিক কলেজ স্কোয়ার, মহম্মদ আলি পার্ক ঘুরিয়ে আনব মা! ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে যায় শিবঠাকুরের। ঠাট্টা করে বোধনের ভোর।

Shiv Durga puja Society
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy