E-Paper

ইতিহাস বুকে নিয়ে নজর টানছে যুদ্ধ-তৎপরতার নীরব সাক্ষী

উত্তর কলকাতার মিল্ক কলোনির পোস্ট অফিস গলিতে ওই জীর্ণ তেতলা বাড়ির দরজায় ঝুলতে থাকা একটি সাইন বোর্ড হঠাৎ সকলের নজর কাড়ছে।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২৫ ০৮:৩৩
ষাটের দশকের যুদ্ধের সাক্ষ্য বহনকারী সেই সাইন বোর্ড রয়ে গিয়েছে রমণী ঘোষের বাড়ির সামনে। মঙ্গলবার, মিল্ক কলোনিতে।

ষাটের দশকের যুদ্ধের সাক্ষ্য বহনকারী সেই সাইন বোর্ড রয়ে গিয়েছে রমণী ঘোষের বাড়ির সামনে। মঙ্গলবার, মিল্ক কলোনিতে। —নিজস্ব চিত্র।

নির্জন পাড়ায় ভাঙাচোরা তেতলা বাড়িটা আচমকাই যেন সকলের নজর কাড়তে শুরু করেছে।

কাশ্মীরের পহেলগামে নিরীহ পর্যটকদের উপরে জঙ্গি হামলার ঘটনার জেরে দেশ জুড়ে যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার আজ, ৭ মে দেশ জুড়ে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে নাগরিক ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে মহড়ার (মক ড্রিল) নির্দেশ দিয়েছে। বিমান হানা হলে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে কী ভাবে আলো নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকার করে শত্রুপক্ষের বিমানকে বিভ্রান্ত করা যাবে, তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা। এই পরিস্থিতিতে উত্তর কলকাতার মিল্ক কলোনির পোস্ট অফিস গলিতে ওই জীর্ণ তেতলা বাড়ির দরজায় ঝুলতে থাকা একটি সাইন বোর্ড হঠাৎ সকলের নজর কাড়ছে।

হলুদ ওই সাইন বোর্ডে লেখা, ‘সিভিল ডিফেন্স, ওয়ার্ডেন্স পোস্ট নম্বর ১, মানিকতলা’। বাড়ির মালিক রমণী ঘোষ ছিলেন সরকারি কর্মী। বেশ কয়েক দশক আগে তাঁর মৃত্যু হয়। পরে তাঁর স্ত্রী-ও প্রয়াত হন। মঙ্গলবার বাড়ির সামনে গিয়ে একাধিক বার ডাকাডাকি করা সত্ত্বেও কেউ দরজা খোলেননি। এলাকার পুরনো বাসিন্দারা জানান, রমণী ষাটের দশকের যুদ্ধের সময়ে সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার পর থেকেই ওই বাড়ির দরজার উপরে রয়ে গিয়েছে এই সিভিল ডিফেন্সের বোর্ড।

বর্তমান প্রজন্ম যুদ্ধের সঙ্গে সেই অর্থে পরিচিত নয়। কিন্তু আচমকাই সিভিল ডিফেন্স, মক ড্রিল, সাইরেন, শেল্টারের মতো শব্দ দেশবাসীর সামনে যেন আচমকা উড়ে এসেছে। ষাটের দশকের সেই যুদ্ধের আমল দেখা, হাতে গোনা কয়েক জন প্রবীণ বাসিন্দাই রয়ে গিয়েছেন মিল্ক কলোনির এই পাড়ায়। তাঁদের দু’-এক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রমণীর বাড়িতে সাইরেন বাক্সও ছিল। প্রশাসন আর পাড়ার সাধারণ লোকজনের মধ্যে যুদ্ধের সেই আবহে যোগাযোগ রক্ষা করতেন রমণী। পাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা তথা প্রাক্তন অধ্যাপক রমেন্দ্রনাথ ঘোষের কথায়, ‘‘দক্ষিণদাঁড়ি এলাকার একটি কারখানায় সাইরেন ছিল। রমণীদার সঙ্গে পুলিশেরও খুব যোগাযোগ ছিল।’’ আর এক পুরনো বাসিন্দা, প্রাক্তন চিত্র সাংবাদিক জানান, রমণী এলাকায় সিভিল ডিফেন্সের তত্ত্বাবধানে ছিলেন। তিনি ছিলেন মানিকতলা এলাকার ওয়ার্ডেন। তাঁর মতো অনেকেই সেই সময়ে রমণীর তত্ত্বাবধানে মক ড্রিলে অংশ নিতেন। রমণীর বাড়িতেও একটি সাইরেন বসানো ছিল। তিনি আরও জানান, ওই সময়ে এলাকায় তৈরি হচ্ছিল কলোনি। সেই নির্মীয়মাণ বাড়িগুলি বাঙ্কার হিসাবে ব্যবহার করা হত।

ঠিক কী করতে হয় সাধারণ মানুষকে? মঙ্গলবার দুপুরে ওই এলাকার দু’-এক জন বাসিন্দার কাছে এ নিয়ে জানতে চাওয়া হলেও তাঁরা স্পষ্ট কিছু বলতে পারেননি। এক পুরনো বাসিন্দার কথায়, ‘‘যত দূর মনে পড়ে, রাতে যে কোনও উপায়ে ঘরের আলো যাতে বাইরে না বেরোয়, জানলা বন্ধ রেখে সেই ব্যবস্থা করতে হত। আলো দেখা গেলে বোমারু বিমান বোমা ফেলে যাবে, এমনটাই বলা হয়েছিল।’’

ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত হবে কিনা, তা সময়ই বলতে পারবে। কিন্তু সিভিল ডিফেন্স, মক ড্রিল, সাইরেন, শেল্টারের মতো বিষয় নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছে কলকাতায়। মিল্ক কলোনি এলাকায় যাঁরা যুদ্ধের সময়ে সাইরেন বেজে ওঠা, ঘর অন্ধকার করে বসে থাকার পরিবেশ প্রত্যক্ষ করেছেন, স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এলেও হাতে গোনা সেই সব প্রবীণ মানুষ মনে করেন, যুদ্ধ না হওয়াই ভাল।

রমণীর ভাঙাচোরা তেতলা শব্দহীন বাড়িও যেন সে কথা বলতে চায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Defense War North Kolkata

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy