শববাহী গাড়ির হাতল ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন মধুমিতা। ‘‘কেন ওদের রেখে গেলাম? না করলে তো আজ এমন হত না,’’— বার বার একই প্রশ্ন করছিলেন নিজেকে। মঙ্গলবার রাতে জোড়াসাঁকো থানা এলাকার হোটেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তামিলনাড়ুর বাসিন্দা এই মহিলার জীবনে নেমে এসেছে চরম অন্ধকার। আগুন লাগার পর হোটেল থেকে বেরোতে না পেরে কালো বিষ ধোঁয়ায় শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে তাঁর দুই সন্তানের।
বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে কলকাতা পুরসভার দু’টি শববাহী গাড়িতে ওই দুই শিশুর মৃতদেহ বার করে আনা হচ্ছিল। সে সময়ে সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ ছাড়া বাস্তবিকই যেন শ্মশানের নিঃস্তব্ধতা। মধুমিতার মেয়ের বয়স দশ বছর, ছেলে তিন বছরের। কাচ ঢাকা গাড়িতে শোয়ানো দুই সন্তানের সামনে গিয়ে বারবার কপাল চাপড়াচ্ছিলেন মধুমিতা। বলছিলেন, ‘‘তোদের ছাড়া আমি কী ভাবে থাকব?’’ এ-ও বলছিলেন, ‘‘ছেলেটা ওর বাবার সঙ্গে সব জায়গায় যেত। কখনও বাবাকে ছাড়তে চাইত না। কিন্তু টিভি দেখতে চেয়ে হোটেলে থেকে গেল!’’ ১৭ এপ্রিল তামিলনাড়ুর বাসিন্দা প্রভু থঙ্গাভেল তাঁর স্ত্রী মধুমিতা, ছেলে পি রিথান, মেয়ে পি দিয়া এবং শ্বশুর এস মুথুকৃষ্ণনকে নিয়ে চেন্নাই থেকে দিল্লি গিয়েছিলেন। দিল্লি থেকে সিকিম, দার্জিলিং ঘুরে দিন দুয়েক আগে এসেছিলেন কলকাতায়। মঙ্গলবার রাতেই হাওড়া থেকে ঘরে ফেরার ট্রেন ছিল তাঁদের।
এ দিন প্রভু জানান, তাঁরা ঋতুরাজ হোটেলের ৩০১ নম্বর ঘরে উঠেছিলেন। স্টেশনের উদ্দেশে বেরোনোর আগে দুই সন্তান ও শ্বশুরকে রেখে খাবার ও অন্যান্য জিনিসপত্র কিনতে বেরিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পরেই মুথুকৃষ্ণন ফোন করে জানান, হোটেলে আগুন লেগেছে। প্রভু বলেন, ‘‘তড়িঘড়ি হোটেলে ফিরে এসে দেখি, দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। কিন্তু ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। শেষে দমকলের একটি মই বেয়ে তিনতলায় উঠলেও ভিতরে যেতে পারিনি।’’
তবে বোন আকৃতি নাভালগাড়িয়াকে বাঁচাতে আগুন উপেক্ষা করেই হোটেলে ঢুকে ছিলেন প্রয়াগরাজের বাসিন্দা কমল নাভালগাড়িয়া। দু’জনের কেউ আর বেরোতে পারেননি। তাঁদের খুড়তুতো ভাই শরদ আগরওয়াল জানান, রাখির প্রদর্শনীর জন্য বড়বাজারে কেনাকাটা করতে এসেছিলেন দাদা-বোন। ঘটনার সন্ধ্যায় কমল বাইরে বেরিয়েছিলেন। আকৃতি তাঁকে এবং বাড়িতে ফোন করে আগুনের খবর জানান। শরদ বলেন, ‘‘কমল হোটেলে ঢুকতে পেরেছে বলে জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু তারপর থেকে ওঁদের ফোনে পাইনি।’’
আনাজের ব্যবসার সঙ্গে যুক্তবিহার থেকে আসা তিন যুবকও ওই হোটেলে ছিলেন। আগুন লাগার পরে তিন জনেই তাঁদের ৪২১ নম্বর ঘর থেকে বেরিয়ে কোনও মতে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে ওঠেন। এ দিন আর জি করের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে রজ্জিত খেমকা ও সাহিল আগরওয়ালের আক্ষেপ, ‘‘আমাদের পিছনেই উঠছিল নীরজও। কিন্তু আচমকাই ওঁকে আর দেখতে পাইনি। চারিদিকে তখন এমন অবস্থা যে, খুঁজতেও যেতে পারিনি। দমকল এসে আমাদের ছাদ থেকে নামায়।’’ পরে নীরজকুমার বর্মার দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পেশায় বস্ত্র ব্যবসায়ী কটকের বাসিন্দা রাজেশকুমার সন্তুকা মাঝেমধ্যেই কলকাতায় আসতেন। কিন্তু এবারে বাড়ি ফিরতে পারলেন না। ফিরতে পারবেন না বুদ্ধগয়ার বাসিন্দা পেশায় ফিজিয়োথেরাপিস্ট রাজেশ কুমারও। ছ'মাস অন্তর কলকাতায় আসতেন রোগীদের জন্য। এ দিন আর জি কর মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর ভাই বিবেক বলেন, ‘‘বাড়িতেদাদার পরিণতি এখনও জানে না। দেহ নিয়ে যাওয়ার পরে কী হবে, বুঝতে পারছি না।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)