কোমর থেকে দেহের নীচের অংশ যাঁর অসাড়, তিনি ডাক্তারি করবেন কী ভাবে?— পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়তলির প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষা ‘নিট’ উত্তীর্ণ হওয়ার পরে চন্দনকুমার মাঝিকে এ প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। ডাক্তারিতে ভর্তি নেওয়ার আগে বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের শারীরিক সক্ষমতা যাচাই করে যে মেডিক্যাল বোর্ড, তারাও চন্দনকে ছাড়পত্র দেয়নি।
সেখানেই ভেঙে যেতে পারত তাঁর ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু চন্দন হাল ছাড়েননি। আদালত ঘুরে শেষে দিল্লি থেকে ছাড়পত্র এনে সম্প্রতি আরামবাগের প্রফুল্লচন্দ্র সেন সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়া শুরু করেছেন বাঘমুণ্ডির কাড়িহেঁসা গ্রামের এই যুবক।
হাল না ছাড়ার শিক্ষা চন্দন পেয়েছেন ছেলেবেলায়। যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন, সে সময়ে দুর্ঘটনায় দেহের নীচের অংশ অসাড় হয়ে যায়। ভেঙে পড়েন। সাময়িক ছেদ পড়ে পড়াশোনায়। পরে স্কুলে অল্প গিয়ে, বেশিটা বাড়িতে পড়াশোনা করে তিনি মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। একটি সংস্থা থেকে অনলাইন ক্লাস করে সাফল্য পান ‘নিট’-এ।
চন্দনের কথায়, ‘‘কাউন্সেলিংয়ের পরে কলকাতার এসএসকেএমে শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা দিতে যাই। কিন্তু সেখানে আমার শারীরিক অবস্থা নিয়ে খোঁটা দেওয়া হয়। মেডিক্যাল বোর্ড আমাকে ‘আনফিট’ ঘোষণা করায় ভেঙে পড়েছিলাম। তবে হাল ছাড়িনি।’’
চন্দনের বাবা, কেটারিং ব্যবসায়ী ভোলানাথ মাঝি বলেন, ‘‘ছেলে ৮০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। কিন্তু তা বলে ডাক্তারি পড়তে পারবে না কেন?’’ ভোলানাথ এলাকার প্রাক্তন কংগ্রেস বিধায়ক নেপাল মাহাতোর সাহায্য চান। নেপালের সহযোগিতায় চন্দনের তরফে কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসুর এজলাসে রিট পিটিশন দাখিল করা হয়। চন্দনের আইনজীবী আলাউদ্দিন আহমেদের দাবি, ‘‘এসএসকেএম-সহ দেশে ১৬টি এ রকম প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিচারপতি তার মধ্যে যে কোনও একটি প্রতিষ্ঠানে চন্দনকে আবেদন করতে নির্দেশ দেন। এ ব্যাপারে সরকার পক্ষের আইনজীবীদেরও সহযোগিতা করতে বলেন। নেপাল বলেন, ‘‘শুধু শারীরিক অক্ষমতার জন্য এক জন প্রতিভাবান এ ভাবে ছিটকে যাবেন, মানতে পারিনি। পরে দিল্লির একটি মেডিক্যাল কলেজ চন্দনকে ডাক্তারি পড়ার জন্য ছাড়পত্র দেয়।’’
তা হলে রাজ্য থেকে কেন ছাড়পড় দেওয়া হল না? এসএসকেএমের ওই বোর্ডের চেয়ারম্যান তথা ফিজ়িক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশনের বিভাগীয় প্রধান চিকিৎসক রাজেশ প্রামাণিক জানান, ওই পরীক্ষার্থী হুইলচেয়ার নির্ভর। পায়ে ‘কেএফও’ নামে একটি ‘ডিভাইস’ পরে ওয়াকার ব্যবহার করেন। তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিশ্চিত ভাবে আছে। রাজেশ বলেন, ‘‘ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনের মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনও অবলম্বন-সহ নিজে দাঁড়াতে পারছেন কিনা, কেএফও-র সাপোর্টে হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে পারছেন কিনা, পায়ে ডিভাইস পরে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে সক্ষম কিনা— এই ধরনের সক্ষমতার মাপকাঠি যদি কেউ পূরণ করতে না পারেন, তবে ফিট সার্টিফিকেট দেওয়া যায় না। ওই পরীক্ষার্থী সব মাপকাঠি পূরণ করতে পারেননি। তাই ফিট সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি।’’ তাঁর দাবি, অন্যত্র কী ভাবে চন্দন ফিট সার্টিফিকেট পেলেন, সেখানে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা দেখা হয়েছিল কিনা, তা তাঁদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
তবে চন্দনের পাশে দাঁড়িয়েছেন আরামবাগ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ রমাপ্রসাদ রায় বলেন, “আমাদের এখানে বিশেষ ভাবে সক্ষমদের জন্য ঢালু সিঁড়ি-সহ সমস্ত ব্যবস্থা আছে। চন্দনের আর যা যা অসুবিধা রয়েছে, তা দূর করার চেষ্টা করছি। এটা আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ।”
চন্দন জানান, আপাতত তিনি কলেজ থেকে কিছুটা দূরে ভাড়া বাড়িতে মায়ের সঙ্গে রয়েছেন। সেখান থেকে কলেজে হুইলচেয়ারে একাই আসা-যাওয়া করেন। তিনি বলেন, ‘‘শুধু ল্যাবরেটরিতে কিছু অসুবিধা হচ্ছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ তা কাটানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।’’ কলেজের অধ্যক্ষ জানান, ডিসেকশন টেবিল-সহ কিছু ক্ষেত্রে উচ্চতার জন্য চন্দনের অসুবিধা হচ্ছে। তাঁকে কোনও কিছুর সাহায্যে যাতে অন্তত এক ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা যায়, সে চেষ্টা কলেজ কর্তৃপক্ষ করছেন। সে জন্য তাঁরা হ্যান্ডিক্যাপ কমিশনেও যোগাযোগ করছেন।
তথ্য সহায়তা: শান্তনু ঘোষ ও পীযূষ নন্দী
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)