Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ছেলেধরার আড়ালে বিভেদের বার্তা

ছেলেধরা গুজব রটিয়ে গণধোলাইয়ের ঘটনা ঘটছে এ রাজ্যেও। হয়েছে মৃত্যুও। কারা রটাচ্ছে এই গুজব? কেন?  আনন্দবাজারের প্রতিবেদন।ছেলেধরা বলে গণধোলাই কিংবা বেঁধে রাখার ঘটনা পূর্ব মেদিনীপুরে এই প্রথম নয়। আলিনান, সাত টিকরি, বাবুনারা, রঘুনাথপুর থেকেও একইরকম খবর মিলেছে। অভিযোগ, প্রতি অঞ্চলে গেরুয়া বসনের ভিক্ষাজীবীদের দেখে বাসিন্দাদের সন্দেহ হয়।

ছেলেমেয়েদের অপহরণের প্রতিটি মেসেজই ধর্মীয় উস্কানিমূলক।

ছেলেমেয়েদের অপহরণের প্রতিটি মেসেজই ধর্মীয় উস্কানিমূলক।

স্যমন্তক ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৮ ০৩:৫৩
Share: Save:

সকাল-সকাল তমলুক থানার বাইরে চায়ের দোকানে আড্ডা জমেছে। রথ-রাজবাড়ি ঘুরে আড্ডা মোড় নিল জাতপাত, ধর্মীয় বিভেদে। রাখঢাক ছাড়াই। কারণ স্পষ্ট। দিন কয়েক আগে সংখ্যালঘু গ্রাম মথুরীতে পিটিয়ে মারা হয়েছে তমলুক পুরসভা অঞ্চলের বাসিন্দা সঞ্জয় চন্দ্রকে। অভিযোগ, ওই যুবক নাকি ‘ছেলেধরা’।

গত এক মাস ধরে শব্দটি জাঁকিয়ে বসেছে পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকে অহরহ ঘুরছে মেসেজ। অদ্ভুত দর্শন কিছু ব্যক্তির মুখ দিয়ে অথবা ছবিহীন টেক্সট মেসেজে বলা হচ্ছে, পূর্ব মেদিনীপুর জুড়ে সক্রিয় ছেলেধরা চক্র। ছেলেমেয়েদের অপহরণ করে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে ভিন দেশে। বিক্রি হচ্ছে কিডনি। প্রতিটি মেসেজই ধর্মীয় উস্কানিমূলক। যার জেরে তমলুক লাগোয়া গ্রামে গ্রামে ভর করেছে ভয়। এমনই এক গ্রাম মথুরীতে ইদের দিন সকালে ঢুকেছিলেন সঞ্জয়। কেন? এখনও ধোঁয়াশা।

সঞ্জয়ের পরিবার এবং বন্ধুদের দাবি, এর আগেও ওই সমস্ত অঞ্চলে গিয়েছেন তিনি, ইলেকট্রিক মিটারের রিডিং নিতে। সঞ্জয়ের পরিবার ও তাঁর বন্ধুদের দাবি, মিটার রিডিংয়ের কাজ করতে গিয়েই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় স্থানীয় সৌরভ আদকের। সৌরভের পরামর্শেই সঞ্জয় নাকি মিটার রিডিংয়ের কাজ ছাড়েন। বছর তিনেক আগে দাদার কাছ থেকে দু’লক্ষ টাকাও তিনি নেন। জানান, সৌরভকে তিনি পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়েছেন। যার বিনিময়ে সৌরভ রেলে চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু তিন বছর কেটে গেলেও চাকরি হয়নি। টাকাও ফেরত আসেনি। এরই জেরে গত বেশ কয়েক মাস ধরে তিনি অবসাদে ভুগছিলেন বলে দাবি তাঁর দিদি বাসন্তী দাসীর।

বাসন্তীর আরও বক্তব্য, সৌরভকে টাকা ফেরতের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন সঞ্জয়। ঘটনার দিন সকালেও সৌরভ সঞ্জয়কে ফোন করেছিলেন বলে পরিবার সূত্রে দাবি। এর পরেই ফোন বাড়িতে রেখে সঞ্জয় মথুরী যান। ঘটনাচক্রে সৌরভের বাড়ি মথুরীর কাছেই। তবে সৌরভ সঞ্জয়কে সত্যিই ফোন করে মথুরীতে ডেকেছিলেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। ঘটনার পর থেকে সৌরভের ফোন বন্ধ। তাঁর বাবা রামপদ জানিয়েছেন, তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না।

মথুরী গ্রাম সূত্রে খবর, সঞ্জয় সে দিন সাইকেল নিয়ে মথুরী গিয়েছিলেন। স্থানীয় এক মহিলা অভিযোগ করেন, তাঁর মেয়েকে নাকি সাইকেলে তোলার চেষ্টা করেছিলেন সঞ্জয়। এর পরেই ‘ছেলেধরা’ বলে তাঁকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। তদন্তে নেমে পুলিশ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে। মূল অভিযুক্তরা এখনও ফেরার। এক সপ্তাহ পরেও গ্রাম থমথমে। পুরুষশূন্য।

ছেলেধরা বলে গণধোলাই কিংবা বেঁধে রাখার ঘটনা পূর্ব মেদিনীপুরে এই প্রথম নয়। আলিনান, সাত টিকরি, বাবুনারা, রঘুনাথপুর থেকেও একইরকম খবর মিলেছে। অভিযোগ, প্রতি অঞ্চলে গেরুয়া বসনের ভিক্ষাজীবীদের দেখে বাসিন্দাদের সন্দেহ হয়। তবে এখনও গ্রামবাসীদের পিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে শুধু সঞ্জয়েরই। বাকিদের উদ্ধার করেছে পুলিশ।

তা হলে কি ‘ছেলেধরা’র গল্প রটিয়ে কেউ বা কারা নিজেদের ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা করছেন? তমলুকে তৃণমূলের টাউন সভাপতি দিব্যেন্দু রায়ের যেমন সন্দেহ, ‘‘রাজনৈতিক স্বার্থে বিজেপি এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভাঙার চেষ্টা চলছে। সেখান থেকেই এই ছেলেধরা কাহিনির জন্ম। এখন বিভিন্ন লোক নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ছেলেধরার গল্প ব্যবহার করে, মানুষকে খেপিয়ে কাজ হাসিল করছেন।’’

স্থানীয় বিজেপি নেতার ব্যাখ্যা অবশ্য ঠিক এর উল্টো। মধুসূদন প্রামাণিক বলেন, ‘‘তৃণমূলই এ ধরনের গল্প রটিয়ে, বিজেপি সমর্থকদের উপরে আঘাত হানছে।’’ সঞ্জয়কে তাঁদের সমর্থক হিসেবেই দাবি করেছেন মধুসূদন।

স্থানীয় শিক্ষক রাজর্ষি মহাপাত্রের ব্যাখ্যা, মাতঙ্গিনী হাজরার অঞ্চল তমলুকে এর আগে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু ইদানীং, বিশেষত, পঞ্চায়েত ভোটের আগে থেকে এলাকার সম্প্রীতি বড়সড় প্রশ্নের সম্মুখীন। ছেলেধরার কাহিনি তারই অংশ হিসেবে দেখছেন রাজর্ষি। দিব্যেন্দুরও দাবি, তমলুক শহরে ইদানীং অচেনা মানুষের আনাগোনা বেড়েছে।

সম্প্রীতিতে যে চিড় ধরেছে, তা চায়ের দোকানের আড্ডা, স্থানীয় দোকানের জটলাতে কান পাতলেই বোঝা যাচ্ছে। স্থানীয় মানুষদের অভিযোগ, ইদানীং নানা ঘটনায় এবিভিপি এবং অল ইন্ডিয়া মাইনরিটি অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশ্যে মিটিং-মিছিল করছে। তাদের প্রচারে মেরুকরণের ইঙ্গিত স্পষ্ট।

‘ছেলেধরা’ গুজবও কি সেই রাজনীতির হাতিয়ার? স্থানীয়দের একাংশের দাবি, অবশ্যই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Rumour Child Lifter
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE