Advertisement
E-Paper

জামাই দিবস

নিছকই খাতিরদারি নয়। পদে পদে ফাঁদ পাতা বাঙালির জামাইবরণে। লিখছেন ঋজু বসুনিছকই খাতিরদারি নয়। পদে পদে ফাঁদ পাতা বাঙালির জামাইবরণে। লিখছেন ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৫ ০৩:১৪

জামাই-বাহিনীই বটে! প্রায় একখানা আস্ত ফুটবল-টিম। শাশুড়ি মায়ের নিজের হাতে বোনা আসনে পর পর বসবে বড়, মেজ থেকে শুরু করে সবার ছোট আনকোরা কোলের জামাইটি। মর্যাদা অনুসারে মধ্যবর্তী চরিত্রগুলো হলেন, সেজ, ন, নতুন, রাঙা ও পুঁটে...।

শান্তিপুরী শাড়ির পাড়ের সুতোয় শাশুড়ি মা আদর করে এক একটি নকশা আঁকবেন, এক্সক্লুসিভ এক এক জনের জন্য। হয়তো বড় জামাইয়ের আসনে বোনা হল প্রজাপতি। আবার কোনটায় গোলাপ, কোনটায় পাখি ফুলের মধু খাচ্ছে। আসনে আবার লেখাও থাকে, ‘সুখে থাকো’, ভাল থাকো’ ইত্যাদি। কোলের জামাইটির আসনের লেখাটিই সব থেকে ভারিক্কি— ‘পতি পরম গুরু’! সব্বাইকে বসিয়ে খাওয়া তদারকি করতে উল্টো দিকে মেহগনি কাঠের পালিশ করা পিঁড়িতে বসবেন শাশুড়ি মা। হাতে তালপাতার পাখা। পুত্রপ্রতিম জামাইদের সামনেও তিনি ঘোমটা খুলবেন না।

সপ্তগ্রামের সুবর্ণবণিক, রাজেন মল্লিকদের পরিবার, কলকাতার মার্বেল প্যালেস এখনও এ ধারা বয়ে বেড়াচ্ছে! গৃহকর্তা হীরেন মল্লিকের এক কথা, সাবেক নিয়মের নড়চড় নেই। তবে এখন পরিবার ঢের ছোট। তাই জামাইয়ের সংখ্যাও কমেছে। সাধারণত, জষ্ঠি মাসে মঙ্গলচণ্ডীর পুজোর পরে ষষ্ঠীর দিনটাই জামাই দিবস। ষষ্ঠী বলে মেয়েদের কপালে নিরামিষই জুটত। তাই মাস না-ফুরোতেই আর একটা দিন, ভুরিভোজের জন্য সক্কলকে ফের ডাকা হত মল্লিকবাড়িতে। মল্লিকবাড়িতে অবশ্য মাংসের প্রবেশ নিষেধ। তবে তপসে ভাজা, পাকা পোনা, চিংড়ির মালাইকারি-পর্ব পেরিয়ে আম, লিচু, ছাড়ানো তালশাঁস ও সরের ক্ষীরের মাধুর্যে কিছুই ফাঁকি পড়ত না। তা ছাড়া, জামাইদের বসতে জরির কাজ করা লাল কার্পেট, পাত পেড়ে খেতে ইতালিয়ান মার্বেলের বাসন, হাত ধুতে পেতলের গাডু-গামলা বা লবঙ্গ-বেঁধা পান মুখে পুরতে রুপোর কৌটোর ডিটেলিংও নিখুঁত।

তবু পুরুষপুঙ্গবের এমন শ্লাঘার দিনেও শেষমেশ স্নেহের ভাষাই শেষ কথাটি বলে যায়। শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রবীণ কর্তা অলককৃষ্ণ দেবের যেমন মনে পড়ে যায় তাঁর শাশুড়ি-মা প্রমীলা বসু এমন দিনে কেমন যত্নে মাছের কাঁটা বেছে স্বহস্তে ভাতের সঙ্গে মেখে দিতেন। মাহিনগরের বসু পরিবারের ন’জামাই অলকবাবু। এবং বাঙালিঘরের সেই সংখ্যালঘুদের এক জন, মাছটা যিনি তেমন কব্জা করতে পারেন না। তাই গড়পারের শ্বশুরবাড়িতে বিভিন্ন জেনারেশনের এক ডজন জামাই, সাত জন শ্যালকের পাশে খেতে বসে খানিক অসহায় বোধ করতেন। ভোজসঙ্গীরা কে কোন রান্নাটা পছন্দ করছে খেয়াল রেখে সন্তর্পণে এক একটা আমিষের বাটি সে দিকে চালানও করে দিতেন অলকবাবু। কিন্তু কাণ্ডটা শাশুড়ি মায়ের চোখ এড়াল না। নিজে এগিয়ে এসে ইলিশের কাঁটা বেছে ভাতের সঙ্গে মেখে জামাইয়ের পাতে তুলে দিলেন। স্নেহের আতিশয্যে জামাইষষ্ঠী তখন সাক্ষাৎ ‘চিলড্রেন্স ডে’।

ময়মনসিংহ, কুমিল্লার উত্তরাধিকার বহন করা কোনও কোনও পরিবারেও এই ‘ষষ্ঠী’তে জামাই যেন বাড়ির ছেলেটিই হয়ে উঠেছেন। খাওনদাওন আপ্যায়নে ফাঁকি নেই। দিনটায় অলিখিত নিয়ম, বাড়ির ছোটদের এক ফোঁটা বকাবকি করা যাবে না। জামাইও যেন তাদেরই এক জন। শাশুড়ি ঠাকরুন, এসে জামাইবাবাজির হাতে ‘বানা’ বেঁধে দিলেন। এখনও যাদবপুর-সন্তোষপুরের দিকের বাজারে এমন দিনের স্পেশাল রেডিমেড বানা-র পসরা সেজে ওঠে। বানা হাতে বাঁধার সুতো বিশেষ। হলুদবাটায় ডুবিয়ে রং করা। এই সুতো জামাইয়ের হাতে বেঁধে শাশুড়িঠাকুরুন, এক সঙ্গে সাজানো দুব্বো, গোটা আম, বাঁশ কুডুল, করমচার ডালির ‘মুঠা’ হাতে করে দেন। তবে বানা মোটেও জামাইদের ‘এক্সক্লুসিভ’ নয়। বাড়ির সব ছোটরাই বানা পাবেন। তবে বানা পরানোর অধিকার মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত। সকাল-সকাল বানা-পর্ব চুকলে মা ষষ্ঠীর উপাসকদের উপোস ভাঙবে। এই বিশেষ প্রাতঃরাশের চিঁড়ে শুকনো শুকনো আঁচে ফেলে নাড়া বা ‘টালা’ হবে। তার পর ক্ষীরে ফেলে হিমসাগর, ল্যাংড়া মিশিয়ে হাপুস-হুপুস শব্দ! এই সোয়াদেই ষষ্টীর সকালটা অন্য মাহাত্ম্য পায়।

বাঙালরা যাকে ‘মুঠা’ বলে, ঘটিবাড়িতে আবার তার নাম ‘বাটা’। তালপাতার পাখা, গোটা আম, দুব্বো, প্রদীপের ভাপের উপচারে জামাই-বরণ না করে শাশুড়ি কিছু দাঁতে কাটবেন না। এ তল্লাটেও হলুদে ডুবিয়ে হালকা সর্ষের তেল ছোঁয়ানো সুতো বাঁধার দস্তুর জামাইয়ের হাতে, তবে ‘বানা’ শব্দটার ঘটিবাড়িতে তত চল নেই। কিন্তু সকালটার চেহারা দেখেই গোটা দিনটা আঁচটা করতে গেলে জামাইবাবাজি মুশকিলে পড়তে পারেন। কারণ, কলকাতার জামাইকে খাতিরদারি মোটেও নিঃশর্ত ছিল না।

তাই জাম্বুকে জব্দ করতে ব্লটিং পেপারের দই, নারকোলকোরার নুন বা কাগজ-ঠোসা শিঙাড়া-মিষ্টির মতো নানা আয়োজনই জমে উঠত। এই জামাই-ঠকানো কসরতের মোকাবিলাই জামাইয়ের পরীক্ষা। এবং তাতে উতরোন মোটেও সোজা কাজ ছিল না। এ কালেও বাঙালির কালচারাল আইকন জলভরা সন্দেশের জন্মের নেপথ্যে জামাই ঠকানোরই কাহিনি। তেলিনিপাড়ার জমিদারগিন্নির বায়নায় প্রথম জলভরা গড়েছিলেন চন্দননগরের সূর্য মোদক। তালশাঁস ছাঁচের সন্দেশের গর্ভে টইটম্বুর গোলাপজল। জামাইবাবাজি কামড়াতে যেতেই গরদের পাঞ্জাবি ভিজে একসা।

অলকবাবুর ভগ্নিপতি কাম ফ্রেন্ড-ফিলোজফার-গাইড, শোভাবাজার রাজবাড়ির জামাই সুশীলকুমার দে-র মতো জামাইয়ের দেখা অবশ্য কদাচিৎ মিলবে। তাঁকে বোকা বানানো অত সোজা নয়। শালা-শালিদের সুরকি ভরা শিঙাড়া বা পেরাকি খাওয়ানোর চক্রান্ত তিনি ঠিক ধরে ফেলতেন। হাতসাফাইয়ের কায়দায় শেষমেশ ওই বস্তু ঠিক প্রতিপক্ষের মুখেই চালান করে ছাড়তেন জাম্বু!

riju basu jamai sasthi hilsa childrens day জামাইষষ্ঠী
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy