প্রিয়া ইরেনে কাবাইয়েরো লোপেস (বাঁ দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।
মা কই! জন্মদাত্রীর খোঁজে শহরে বার্সেলোনার প্রিয়া এ শহরের গলিপথ তাঁকে চেনে না। ঠিক যেমন নিজের জন্মদাত্রী মাকে চেনেন না তিনি!
সেই মায়ের খোঁজেই প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ভরা-শীতের কলকাতায় এসেছেন প্রিয়া। প্রিয়া ইরেনে কাবাইয়েরো লোপেস। একবুক উৎকণ্ঠা নিয়ে স্পেনের বার্সেলোনা থেকে কলকাতায় আসা এই মেয়ে মঙ্গলবার শীত-দুপুরে দাঁড়িয়েছিলেন এক অচেনা-অজানা গলির কোণে। কথার পিঠে কথা এগোতেই এক সময়ে কেঁদে ফেললেন ঝরঝরিয়ে। ধরা গলায় প্রশ্ন ভেসে এল, ‘‘কোথায় আমার মা?’’
২৬ বছর আগে যে মায়ের জঠরে প্রিয়ার জন্ম, তাঁকে কখনও চোখে দেখেননি প্রায় জন্ম-ইস্তক স্পেনবাসী এই তরুণী। কলকাতা থেকে সদ্যোজাত প্রিয়াকে দত্তক নিয়ে বার্সেলোনায় চলে যান হাভিয়ের ও কারমেন। ‘কখনও না দেখা মায়ের কথা’ অবশ্য ছোটবেলাতেই প্রিয়াকে জানিয়েছিলেন তাঁরা। প্রিয়ার কথায়, ‘‘মাকে কখনও না দেখলেও, তাঁকে অনুভব করতে পারি আমি।’’ বছর দশেক আগে সেই মায়ের খোঁজে এক বার কলকাতায় এসেওছিলেন। কিন্তু খানিকটা হকচকিয়ে গিয়েই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে শহর ছেড়েছিলেন তিনি। এ বার ফের খোঁজ।
স্পেনীয় দোভাষীর মাধ্যমে প্রিয়া বলছিলেন, ‘‘এ বার মন শক্ত করে এসেছি। ক’টা দিন থাকব।’’ সঙ্গে পালিত বাবা-মা ছাড়াও অঞ্জলি পওয়ার ও অরুণ ডোল। জন্মদাত্রী মাকে খুঁজে বার করতে সাহায্য করছেন তাঁরা। দত্তক নেওয়া বাবা-মা তাঁকে বড় করেছেন যত্নে, ভালবেসে। তবু জন্মদাত্রীকে অন্তত এক বার দেখার ইচ্ছে পিছু ছাড়েনি। প্রিয়ার কথায়, ‘‘খুব জানতে ইচ্ছে করে, মা কেমন আছেন। জানাতে ইচ্ছে করে, তোমার সন্তান, তোমার মেয়ে ভাল আছে। তোমার উপরে তার কোনও রাগ নেই। তোমাকে সে ভোলেনি। আমার কাছে তুমি ও আমার পালিতা মা, দু’জনেই খুব প্রিয়। আর কিছু না।’’
কিন্তু আড়াই দশক পেরিয়ে কাউকে চাইলেই কি এত সহজে খুঁজে পাওয়া যায়? অঞ্জলি জানালেন, ‘‘প্রিয়াকে মাদার টেরিজ়ার হোম থেকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল। সেখানকার নথিপত্রে পাওয়া মায়ের নাম নিয়ে কলকাতা পুরসভা, নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল খুঁজেও কোনও রেকর্ড পাইনি। একটা ‘আবছা ঠিকানা’ পাওয়া গিয়েছে মাদার হোম থেকে।’’ আর সেই ঠিকানা নিয়েই কার্যত খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার মতো মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন প্রিয়া।
বার্সেলোনায় প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন প্রিয়া। বলছিলেন, ‘‘কলকাতার মতোই ঘিঞ্জি আমাদের শহর...। ফর্সা বাবা-মায়ের শ্যামলাবরণ মেয়ে দেখে সে দেশেও প্রথমে অনেকে প্রশ্ন করতেন। কিন্তু এখন চেনা-পরিচিতরা সকলেই জানেন যে, প্রিয়ার শরীরে বইছে কোনও বাঙালি মায়ের রক্ত।
অঞ্জলির আশঙ্কা, অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের আগে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া মায়েদের সন্তান হাতবদল হয়ে হোমে চলে যায়। সেখান থেকে দত্তক। জন্মদাত্রী সেই মা হয়তো আজ অতীতের বুকে বহু কষ্টে পাথরচাপা দিয়ে সংসারী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা আর পরিত্যক্ত সন্তানদের সামনে আসতে চান না। তবু আশা জাগিয়ে রেখে তাঁর বক্তব্য, ‘‘তবে অনেকে দেখা করেনও। আমরা তাই একবুক আশা নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি।’’
চলার পথে আশপাশের বাড়ি-ঘর, দোকান, পথ-ঘাট দেখছিলেন প্রিয়া। কারমেনের হাত চেপে ধরে এক বার বললেন, ‘‘এমনই কোনও এক গলির এক বাড়িতে হয়তো একদিন আমার মা ছিল, তাই না?’’
দু-গাল বেয়ে ফের জলের ধারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy