Advertisement
E-Paper

জেদ ধরে বিএসএফে ঢুকেছিলেন অভিজিৎ

সবাইকে পিছনে ফেলে নিমেষে পেরিয়ে যেতেন বর্ষা জলে উপচে পড়া জলাধার। বাড়ির অমতে জেদ করেই যোগ দিয়েছিলেন সেনা বাহিনীতে। সাঁতারে দক্ষতা তাঁকে জায়গা দিয়েছিল বিএসএফ-এর ওয়াটার পোলো দলেও। দেশরক্ষা করতে গিয়ে আর ফিরতেন পারলেন না পুরুলিয়ার সাঁতুড়ির অচেনা মধুবনপুর গ্রামের সেই তরুণ জওয়ান অভিজিৎ নন্দী (২৪)।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৫ ০১:০০
শোকে জ্ঞান হারিয়েছেন মা। সান্ত্বনা পড়শিদের। (ইনসেটে নিহত জওয়ান)— নিজস্ব চিত্র

শোকে জ্ঞান হারিয়েছেন মা। সান্ত্বনা পড়শিদের। (ইনসেটে নিহত জওয়ান)— নিজস্ব চিত্র

সবাইকে পিছনে ফেলে নিমেষে পেরিয়ে যেতেন বর্ষা জলে উপচে পড়া জলাধার। বাড়ির অমতে জেদ করেই যোগ দিয়েছিলেন সেনা বাহিনীতে। সাঁতারে দক্ষতা তাঁকে জায়গা দিয়েছিল বিএসএফ-এর ওয়াটার পোলো দলেও। দেশরক্ষা করতে গিয়ে আর ফিরতেন পারলেন না পুরুলিয়ার সাঁতুড়ির অচেনা মধুবনপুর গ্রামের সেই তরুণ জওয়ান অভিজিৎ নন্দী (২৪)। বাড়ি থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে কাশ্মীরে রবিবার পাক সেনার গুলিতে শহিদ হলেন ওই বাঙালি বিএসএফ জওয়ান।
রবিবার সন্ধ্যায় কাশ্মীর থেকে প্রথম ফোনটা পাওয়ার পরেই কু ডেকেছিল ভাই চিরঞ্জিতের। দ্বিতীয় ফোনেই এসেছিল মর্মান্তিক খবরটা। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভারী গলায় বিএসএফ-এর এক আধিকারিক তাঁকে জানিয়েছিলেন, ‘দেশ রক্ষা করতে গিয়ে শহিদ হয়েছেন অভিজিৎ নন্দী’। তার পর থেকে আঁধার নেমেছে বিএসএফ-এর ১১৯ নম্বর ব্যাটেলিয়নের শহিদ জওয়ানের এক চিলতে মাটির বাড়িতে। ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরেই একেবারে চুপ মেরে গিয়েছেন বাবা মধুসূদন নন্দী। কেবলই জ্ঞান হারাচ্ছেন মা ঝর্নাদেবী। আর কান্না লুকিয়ে বাবা-মাকে সামলাতে ব্যস্ত ছোট ছেলে চিরঞ্জিৎ। পেশায় ক্ষুদ্র চাষি মধুসূদনবাবু কষ্ট করে বড় করেছিলেন দুই ছেলেকে। বিএসএফে অভিজিতের চাকরির পরে কিছুটা হলেও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ফিরছিল এই দরিদ্র পরিবারের। শেষবার ছুটিতে ফিরে বাড়ি পাকা করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিল। কিন্তু, তার আগেই পাক সেনার একটি বুলেটে তছনছ হয়ে গেল গোটা পরিবারের স্বপ্ন।

এ দিন সকালে গ্রামের নামো পাড়ায় অভিজিতের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায় গ্রামবাসীরা জটলা করছেন। টালির ছাদের কাঁচা বাড়ি। সেখানে সামনের উঠোনে শুয়ে ঝর্নাদেবী। তাঁকে ঘিরে পড়শি মহিলারা। ভেতরের ঘরে শূন্য দৃষ্টিতে ছাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন মধুসূদনবাবু। কোনও রকমে কান্না আড়াল করতে করতে অভিজিতের ভাই চিরঞ্জিত বললেন, ‘‘খবরটা আসার পর থেকেই বাবা কোনও কথাই বলছেন না। সন্ধ্যা থেকেই বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন মা। কী করব, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।’’ হঠাৎ-ই জ্ঞান ফিরে উঠে বসতে দেখা যায় ঝর্নাদেবীকে। তার পরেই বিলাপ, ‘‘ওগো আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও গো। বলে গেলি, দেশ রক্ষা করতে যাচ্ছি। ভয় নেই। আমাদের কেন ছেড়ে গেলি বাবা!” জ্ঞান হারাতেই মহিলাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন পড়শিরা।

পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ভাল খেলোয়াড় এবং সাঁতারু হিসেবে পরিচিত অভিজিৎ উচ্চ মাধ্যমিকের পরেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। ২০০৮ সালে স্থানীয় এসআরবিপি হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সেনাবাহিনীর পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। বছর সাড়ে তিন আগেই স্বপ্নটা সত্যি হয়েছিল। হাজারিবাগে এক বছরের প্রশিক্ষণ শেষে অভিজিৎ প্রথম পোস্টিং পেয়েছিলেন নদিয়ার বাংলাদেশ সীমান্তে। ছেলেবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাজীব মাজি, সুব্রত নন্দীরা বলেন, ‘‘দক্ষ সাঁতারু হওয়ায় অল্প দিনেই অভিজিৎ বিএসএফের ওয়াটার পোলো দলে সুযোগ পায়। জাতীয় ও রাজ্য স্তরের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে যোগ দিয়ে একাধিক পদকও জিতেছে।’’ বাড়িতে ফিরলেই নিজের প্রিয় পদকগুলো ঝেড়ে মুছে রাখতেন অভিজিৎ।

মার্চ মাসের শেষ দিকে লম্বা ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন অভিজিৎ। কাজে যোগ দেওয়ার পরেই যেতে হয়েছিল অশান্ত কাশ্মীরে। বাড়িতে শেষ ফোন করেছিলেন শনিবার বিকেলেই। ভাইকে জানিয়েছিলেন, ছোট বাড়িটাতে বাবা-মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছে। পুজোয় ফিরে পাকা বাড়ি বানানোর কাজ শুরু করবেন। তার আগেই জাতীয় পতাকায় মুড়ে কফিনবন্দি হয়ে ফিরছে গ্রামের প্রিয় ছেলের দেহ। রবিবার বেলা ৩টে নাগাদ উত্তর কাশ্মীরের কুপওয়ারা জেলার সীমান্তে বিএসএফ ক্যাম্প লক্ষ্য করে বিনা প্ররোচনায় গুলি ও মর্টার চালায় পাকিস্তানি সেনা। তাতেই শহিদ হন অভিজিৎ। তাঁর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়, পড়শি দয়াময় নন্দী, শান্তিরাম মাজিরা বলছেন, ‘‘এত কম বয়সে কারও মৃত্যু কখনই মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু এটা ভেবে গর্ব হচ্ছে, দেশরক্ষা করতে গিয়ে শহিদ হয়েছে ছেলেটা।”

এ দিন মধুসূদনবাবুকে সান্ত্বনা দিতে এসেও ঘরে আর ঢুকতে পারেননি গ্রামেরই বাসিন্দা মানিকচন্দ্র দাঁ। আট বছর আগে ঠিক এ রকমই একটা দিনে কাশ্মীর থেকে ফোনে ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন মানিকবাবু। ছেলে শুভেন্দু ছিলেন সিআইএসএফ জওয়ান। পালিয়ে যাওয়ার সময় বৃদ্ধ বললেন, ‘‘‘বাবা হয়ে ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার অভিজ্ঞতা ঠিক কেমন, তা জানি। মধুসূদনকে সান্ত্বনা দিতে এসেও বাড়ির ভিতরে আর ঢুকতে পারলাম না।”

shuvraprakash mondal abhijit nandi bsf job bsf jawan killed pak firing indo pak border border firing kashmir border
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy