Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

শিল্পকর্তা পেটানোয় অভিযুক্তরা ছাড় পেলেন মুখ্যমন্ত্রীর ‘রায়ে’

জামুড়িয়ার শ্যাম স্টিলে গত বছর জুলাই মাসে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের হামলার পর তিনি বলেছিলেন, “ঘটনাটি সংবাদমাধ্যম বড় করে দেখাচ্ছে!” সাত মাসের মধ্যেই হাওড়ার বার্ন স্ট্যান্ডার্ডে তৃণমূল নেতাদের হাঙ্গামা ও মারধরের ঘটনা নিয়ে তদন্তের আগেই বৃহস্পতিবার ‘রায়’ ঘোষণা করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী! এবং এ বারেও তাঁর রায়ে ছাড় পেয়ে গিয়েছেন সংস্থার জেনারেল ম্যানেজারকে মারধরে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা-কর্মীরা!

সমঝোতায় আসার পর বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের কর্মীদের সঙ্গে জিএম শান্তনু সরকার (মাঝখানে)। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

সমঝোতায় আসার পর বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের কর্মীদের সঙ্গে জিএম শান্তনু সরকার (মাঝখানে)। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৪:০১
Share: Save:

জামুড়িয়ার শ্যাম স্টিলে গত বছর জুলাই মাসে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের হামলার পর তিনি বলেছিলেন, “ঘটনাটি সংবাদমাধ্যম বড় করে দেখাচ্ছে!” সাত মাসের মধ্যেই হাওড়ার বার্ন স্ট্যান্ডার্ডে তৃণমূল নেতাদের হাঙ্গামা ও মারধরের ঘটনা নিয়ে তদন্তের আগেই বৃহস্পতিবার ‘রায়’ ঘোষণা করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী! এবং এ বারেও তাঁর রায়ে ছাড় পেয়ে গিয়েছেন সংস্থার জেনারেল ম্যানেজারকে মারধরে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা-কর্মীরা!

কী বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী? এ দিন দুপুরে বিধানসভা ভবনে সাংবাদিক বৈঠক করে তিনি বলেন, “তিন জায়গা থেকে আমি ক্রস-চেক করেছি। জেলার মন্ত্রী অরূপ রায়কে ডেকে রিপোর্ট নিয়েছি। জেনেছি, তর্কাতর্কি হয়েছে। মারপিটের ঘটনা ঘটেনি।” মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরে প্রত্যাশিত ভাবেই অভিযুক্তদের কাউকে ধরা দূরের কথা, জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেনি পুলিশ!

মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “আমরা এর আগে ছোট ঘটনা, সামান্য ঘটনা, সাজানো ঘটনা, তুচ্ছ ঘটনা এ সব বার বার শুনে অভ্যস্ত। এখানে উনি কোন সূত্র থেকে কী খবর পেয়েছেন, উনিই জানেন!” কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ও বলেন, “পুলিশ জানে, মুখ্যমন্ত্রী শেষ কথা বলে দিয়েছেন। এর পর পুলিশের কি হিম্মত আছে মুখ্যমন্ত্রী যা বলেছেন তা ‘ঠিক নয়’ বলার?”

মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে শুধু বিরোধীরা নন, ক্ষুব্ধ স্থানীয় তৃণমূলের একাংশও। তাঁর দলের শ্রমিক সংগঠনের নেতারাই কড়া ভাষায় এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কী বলেছেন তাঁরা?

দলনেত্রীর বক্তব্যের কথা জানতে পেরে বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের একটি তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের সম্পাদক প্রশান্ত ঘোষ বলেন, “দিদির কানে ভুল বার্তা দেওয়া হচ্ছে। তা দিচ্ছেন জেলা সভাপতি অরূপ রায়। তিনি নিজেকে বাঁচানোর জন্য মারধরের কথা অস্বীকার করছেন! কিন্তু আমরা জানি, পুরসভার কোন কোন নেতা এসে জেনারেল ম্যানেজারকে মারধর করেছেন।” তৃণমূলেরই একটি ইউনিয়নের নেতা এবং স্থানীয় ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শৈলেশ রাই বলেন, “দলের কিছু লোক বাইরে থেকে আমার ওয়ার্ডে এসে গুন্ডামি করে যাবেন, তা বরদাস্ত করব না।” ওই ঘটনার প্রতিবাদে এ দিন সকাল থেকে কারখানার গেটের সামনে অনশনেও বসেন শৈলেশবাবু। দুই শ্রমিক নেতারই অভিযোগ, নিজেকে বাঁচাতে নেত্রীকে ভুল বোঝাচ্ছেন মন্ত্রী অরূপবাবু। মন্ত্রী অবশ্য দলের নেতা-কর্মীদের একাংশের এই অভিযোগ মানতে চাননি। তিনি বলেন, “যাঁরা এমন কথা বলছেন, তাঁরা আমাদের ইউনিয়ন করেন না!”

শুধু তৃণমূলের শ্রমিক নেতারা নন, এ দিন বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের পাঁচটি শ্রমিক সংগঠনের (যার দু’টি তৃণমূলের দখলে) সব নেতাই অভিযোগ করেন, বুধবার বাইরের লোক এসে কারখানায় গুন্ডামি করে গিয়েছে। তাঁদের দাবি, “এই গুন্ডামির পিছনে তৃণমূল নেতৃত্ব আছেন।” কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বুধবার কারখানায় হামলায় মদত দেওয়ার অভিযোগে দুই স্থায়ী কর্মী আকাশ মল্লিক ও দেবাশিস চক্রবর্তীকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।

মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে এ দিন সন্ধ্যায় কারখানার গেট খোলা হলেও তৃণমূলের যে নেতাদের বিরুদ্ধে মারধরের অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টে ওই সব নেতা এবং বিক্ষোভরত শ্রমিকদের প্রতি তাঁর যে পূর্ণ সমর্থন রয়েছে, তা এ দিন বুঝিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “১৭৫ জন শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছিল। তারা নাকি এমডি-র সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল। তখন তাদের গেট-আউট বলেছে। মারপিট হয়নি। তর্কাতর্কি হয়েছে। কথা কাটাকাটি হয়েছে। মারপিট হলে তো ছবি দেখা যেত।” যদিও কারখানা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ ছিল, ঘটনার পরে জোর করে সিসিটিভির ফুটেজ মুছে ফেলা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ এ দিন জানিয়েছেন, ওই ফুটেজ উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে।

যদিও ওই ফুটেজ উদ্ধার হলেই বা কী লাভ হবে, তা বুঝতে পারছেন না কারখানার কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য তো তদন্তে জল ঢেলে দিয়েছে! এর পরে কী তদন্ত করবে পুলিশ? তৃণমূলেরই এক শ্রমিক নেতা বলেন, “বুধবার রাতে ভারতীয় দণ্ডবিধির যে ৫০৬ (হুমকি), ৩২৩ (ইচ্ছাকৃত আঘাত) নম্বর ধারায় তিন তৃণমূল মেয়র পারিষদ, এক জন প্রাক্তন কাউন্সিলর এবং দু’জন তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হল, তার ভবিষ্যৎ কী?”

গত কালের গণ্ডগোলের পরে এ দিন ভোরে কাজে যোগ দিতে এসে ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’-এর নোটিস দেখেন শ্রমিকেরা। এ নিয়ে ইতস্তত গোলমাল শুরু হয়। কেউ কেউ গেট টপকে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করায় ৭টা নাগাদ কারখানার গেট খুলে দেন কর্তৃপক্ষ। তবে কাজ বন্ধই ছিল। কাজ বন্ধের খবর যায় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। দুপুরে তিনি বলেন, “ওরা আজ সকাল থেকে হঠাৎ করে সাসপেনশন অব ওয়ার্ক করে দিল, এটা তো ঠিক নয়। ঝগড়াঝাঁটি না করে দু’পক্ষকে যাতে একসঙ্গে ডেকে কথা বলা যায়, মুখ্যসচিবকে তা বলেছি।” এর পরেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ কারখানায় আসেন জিএম শান্তনু সরকার। তিনি জানান, রাজ্য সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে তাঁদের আলোচনা হয়েছে। কারখানা পরিচালনার বিষয়ে নিরাপত্তার আশ্বাস পাওয়া গিয়েছে। তাই সাসপেনশন অব ওয়ার্কের নোটিস তুলে নেওয়া হল। শান্তনুবাবু বলেন, “নিরাপত্তার আশ্বাস পাওয়ার পরেই আমরা ফের কারখানা খুলছি। কাল থেকে ফের কাজ চালু হবে।” একই সঙ্গে তিনি জানান, রেল মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের অনুমতি নিয়েই এই নোটিস প্রত্যাহার করা হয়েছে।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজে পুনর্বহালের দাবিতে কারখানার গেটের সামনে অনশন করছিলেন অস্থায়ী শ্রমিকেরা। এই শ্রমিকদের ইউনিয়নের কোনও স্বীকৃতি নেই বলে এ দিন দাবি করেন পাঁচ শ্রমিক সংগঠনের নেতাই। এ দিন তাঁরা বলেন, “কোথা থেকে আচমকা ওরা একটা সংগঠন বানালো, তা জানি না!” মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য এ দিন অস্থায়ী শ্রমিকদের পক্ষ নিয়ে বলেন, “তাঁদের পরিবার রয়েছে। তাঁদের দিকটাও দেখতে হবে।” বুধবারের গণ্ডগোলের সূত্রপাত এই অস্থায়ী শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া নিয়েই। অভিযোগ, বিষয়টি নিয়ে কারখানার ভিতরে ঢুকে তাণ্ডব চালান তৃণমূলের নেতারা। কারখানা কর্তৃপক্ষ এ দিনও বলেছেন, “যাঁরা অনশন করেছিলেন, তাঁদের সংগঠন স্বীকৃত নয়। তাই ওঁদের দাবি মানার কোনও প্রশ্নও নেই।” গত কালের ডামাডোলের পরেও ওই অস্থায়ী শ্রমিকেরা অনশন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পরে হাওড়া জেলার তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি অরূপেশ ভট্টাচার্য কারখানায় গিয়ে তাঁদের তুলে দেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

burn standard mamata banerjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE