Advertisement
E-Paper

সেতুভঙ্গকে অস্ত্র করেই ‘সেতু বাঁধতে’ মরিয়া অধীর, চমক দিলেন মইনুলকে টেনে

বৃহস্পতিবার জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি এবং ফরাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে নিয়ে সেই সেতু পরিদর্শন করলেন বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধীর চৌধুরী। সঙ্গে নিলেন ফরাক্কার পাঁচ বারের কংগ্রেস বিধায়ক মইনুল হককে।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১৮:৩৯
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

দলের সাধারণ সমর্থকদের সঙ্গে নেতৃত্বের যোগাযোগের ‘সেতু’ প্রায় নেই। প্রদেশ থেকে বুথ— প্রায় সব স্তরের কংগ্রেস নেতাদেরই যতটা পেরেছে ভাঙিয়ে নিয়েছে তৃণমূল। কিছু কিছু ‘পকেটে’ এখনও খানিক ভোট কংগ্রেসের রয়েছে। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে নেতৃত্বের নিয়মিত যোগসূত্র বলতে প্রায় কিছুই নেই। দলের মনোবল বাড়াতে এবং নীচের তলার সঙ্গে যোগাযোগের সেতু আবার জুড়তে সেতুভঙ্গকেই হাতিয়ার করলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। এক ‘তৃণমূলমুখী’ কংগ্রেস বিধায়ককে সঙ্গী করে বৃহস্পতিবার কিছুটা চমকও দিয়ে দিলেন তিনি।

ফরাক্কা ব্যারাজ সংলগ্ন সেতু এমনই একটি সেতু, যেটা ছাড়া উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের কোনও সরাসরি সড়ক যোগাযোগ থাকবে না। কিন্তু বছরের পর বছর প্রায় কোনও রক্ষণাবেক্ষণই হয়নি ফরাক্কা সেতুর। দুর্বিষহ অবস্থা সেতুটির উপর দিয়ে যাওয়া রাস্তার। রেলিং ভেঙে গিয়েছে নানা জায়গায়। কংক্রিটও জরাজীর্ণ কোথাও কোথাও। বিপর্যয় ঘনিয়ে আসা অস্বাভাবিক নয়, বলছেন বিশেষজ্ঞরাই।

মাঝেরহাটে সেতু ভেঙে পড়ার পর থেকে রাজ্যের অনেক সেতুর স্বাস্থ্য নিয়েই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ফরাক্কার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেতুও সেই তালিকায় রয়েছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি এবং ফরাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে নিয়ে সেই সেতু পরিদর্শন করলেন বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অধীর চৌধুরী। সঙ্গে নিলেন ফরাক্কার পাঁচ বারের কংগ্রেস বিধায়ক মইনুল হককে।

আরও পড়ুন: মাঝেরহাটে তৈরি হবে এক জোড়া বেইলি ব্রিজ

রাজ্যের সেতুগুলির অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে আগেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা বহরমপুরের সাংসদ। অধীর নিজে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। ফলে ফরাক্কা-সহ বাংলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতির বিষয়ে অধীরের মতামত গুরুত্ব দিয়েই শুনেছিলেন গডকড়ী। ফরাক্কার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে শীঘ্রই বিশেষজ্ঞদের পাঠানো হবে বলে গড়কড়ী আশ্বাসও দিয়েছিলেন অধীরকে। বৃহস্পতিবার সেই পরিদর্শনই হল।

ফরাক্কা ব্রিজে পরিদর্শনের সময় অধীরের পাশে মইনুল (পাশে সাদা পাঞ্জাবী পরা)। —নিজস্ব চিত্র

অধীর-মইনুলদের সঙ্গে এ দিন ফরাক্কা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের বিশেষজ্ঞরা। ছিলেন ফরাক্কা ব্যারাজ কর্তৃপক্ষের জেনারেল ম্যানেজার শৈবাল ঘোষও। সেতুর অবস্থা ঠিক কী রকম, কোন কোন অংশে কী ধরনের মেরামতি দরকার, সে সব সরেজমিনে খতিয়ে দেখেন তাঁরা। এই মেরামতির জন্য কত দিন সময় লাগতে পারে, সে বিষয়েও প্রাথমিক কথাবার্তা হয়। কিন্তু মেরমতির জন্য আদৌ ওই সেতু বন্ধ রাখা সম্ভব কি না, সে বিষয়েও সাংসদ-বিধায়কের সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের তথা জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ এবং ব্যারাজ কর্তৃপক্ষের কথা হয়। প্রয়োজনে সেতুর এক পাশের রাস্তা খোলা রেখে অন্য পাশে মেরামতির কাজ চালানো হবে— এই মর্মেও প্রাথমিক কথাবার্তা হয় বলে খবর। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে সঙ্গে নিয়ে এ দিন বিকেলে বহরমপুরে ভাগীরথীর উপরে নির্মীয়মাণ সেতুও অধীর পরিদর্শন করেন।

আরও পড়ুন: সেতুর হাল খারাপ? এই নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ করুন, বললেন মন্ত্রী

ফরাক্কা সেতু মুর্শিদাবাদ এবং মালদহের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করছে। মুর্শিদাবাদ অধীরের নিজের জেলা ঠিকই। কিন্তু ফরাক্কা অধীরের নির্বাচনী ক্ষেত্র বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত নয়। ফরাক্কা বিধানসভা দক্ষিণ মালদহ লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে, সেখানকার সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী। এই আবু হাসেম এবং তাঁর ভাগ্নি তথা উত্তর মালদহের সাংসদ মৌসম নূর তৃণমূলের দিকে পা বাড়িয়ে রয়েছেন বলে জল্পনা চলছে কংগ্রেসের অন্দরেই। হাইকম্যান্ডের কাছে আবু হাসেম খান চৌধুরী ওরফে ডালু সওয়াল করেছেন তৃণমূলের সঙ্গে জোটের পক্ষেই। কয়েক মাস আগে জোট প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে তিনি তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িও পৌঁছে গিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার ফরাক্কা পরিদর্শনের সময়ে সেই ডালুকে সঙ্গে না রেখে অধীর কোনও বার্তা দিলেন কি না, তা নিয়ে নানা জল্পনা তো শুরু হয়েইছে, অধীরের পাশে এ দিন সারা ক্ষণ ফরাক্কার বিধায়ক মইনুল হকের উপস্থিতিও নজর কেড়েছে রাজ্যের রাজনৈতিক শিবিরের।

পরিদর্শনের ফাঁকেই ফরাক্কার আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলছেন অধীর। —নিজস্ব চিত্র

মইনুল হকের সঙ্গে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠতা ক্রমশ বাড়ছিল গত কয়েক বছর ধরে। দলের অন্য অনেক বিধায়কের মতো মইনুলও জার্সি বদলে ফেলবেন বলে অনেকেই মনে করছিলেন। ডালুবাবু যে দিন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছিলেন, সে দিন তাঁর সঙ্গে মইনুলই ছিলেন। সেই কারণেই বৃহস্পতিবারের ছবিটা অনেককে চমকে দিয়েছে। যে লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ফরাক্কা ব্যারাজের অবস্থান, সেই দক্ষিণ মালদহের সাংসদ ডালু পরিদর্শনে নেই। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ এবং ব্যারাজ কর্তৃপক্ষকে নিয়ে পরিদর্শন করলেন অধীর। আর ডালুকে সঙ্গে নিয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি যেতে দেখা গিয়েছিল ‘তৃণমূলমুখী’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা যে বিধায়ককে, সেই মইনুল সারা ক্ষণ অধীরের কাঁধে কাঁধ ঘষতে ঘষতে হাঁটলেন ফরাক্কা সেতুতে। এই দৃশ্য তৃণমূলের জন্য খুব সুখের নয়।

বিধান ভবন সূত্রের খবর, ফরাক্কার পাঁচ বারের বিধায়ক মইনুলের সঙ্গে দলের প্রদেশ নেতৃত্বের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সে দূরত্ব এখন অতীত। রাহুল গাঁধী নিজে মইনুলকে অনুরোধ করেছেন কংগ্রেস না ছাড়তে। তাই মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসে ধাক্কা দিয়ে আখরুজ্জামান, আবু তাহেরের মতো বিধায়করা সম্প্রতি তৃণমূলে চলে গেলেও মইনুল যাননি। এবং এ বার তৃণমূলপন্থী হিসেবে পরিচিত কংগ্রেস সাংসদ ডালুবাবুর বদলে মইনুলকে দেখা গেল কট্টর তৃণমূল বিরোধী অবস্থানে থাকা অধীরবাবুর পাশে।

অধীরের পদক্ষেপ অবশ্য শুধু মইনুলকে পাশে টানায় সীমাবদ্ধ নেই। সেতু বিপর্যয় কাণ্ড নিয়ে, কিছুটা দেরিতে হলেও, বড়সড় রাজনৈতিক তৎপরতার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে একাধিক বার রাজ্য সরকারকে তীব্র ভাষায় তিনি আক্রমণ করেছেন। বার বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন। পূর্ত মন্ত্রীর চেয়ার থেকে অরূপ বিশ্বাসকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। রাজ্য জুড়ে ছোটখাটো মিটিং-মিছিল-পথসভা-বিক্ষোভ-ডেপুটেশনের আয়োজন করিয়ে সেতু বিপর্যয় ইস্যুকে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা শুরু করেছেন। কংগ্রেসকেও কিছুটা প্রাসঙ্গিক করে তোলার চেষ্টা করেছেন সে সবের মাধ্যমে। তার পরে গতকাল অর্থাৎ বুধবার কংগ্রেস প্রতিনিধিদলকে সঙ্গে নিয়ে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠির সঙ্গে অধীর দেখা করেছেন। রাজ্যপালের কাছে ডেপুটেশন জমা দিয়েছেন এবং রাজ্যের বিভিন্ন সেতুর হাল খারাপ হওয়া নিয়ে রাজ্য সরকারের দিকেই ফের আঙুল তুলেছেন।

প্রথমে নিচু তলায়, তার পরে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের কাছে— তৃণমূল পরিচালিত সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ সব স্তরে পৌঁছে দেওয়ার পরে নিজের মতো করে ময়দানে নেমেছেন অধীর। অন্তত তেমনটা দেখাতে চেয়েছেন। সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসেবে তাঁর যেটুকু ক্ষমতা রয়েছে, তা কাজে লাগিয়েই তিনি রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সেতুগুলির হাল ফেরানোর চেষ্টা শুরু করেছেন— জনমানসে অধীর এই বার্তাই এ বার দিতে চাইছেন। ফরাক্কা এবং বহরমপুরে সেতু পরিদর্শন করেছেন তিনি। এই ধরনের আরও বেশ কিছু কর্মসূচি তিনি নেবেন বলে কংগ্রেস সূত্রের খবর। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি চাইছেন, লাগাতার এই সব কর্মসূচির মাধ্যমে কংগ্রেস রাজ্যে আবার নিয়মিত আলোচনায় ফিরে আসুক। আর তার মাধ্যমেই বাড়ুক নীচের তলার কর্মী-সমর্থকদের মনোবল।

আগেও এই ধরনের কর্মসূচি নিয়ে সাফল্য পেয়েছেন অধীর চৌধুরী। বাম জমানায় নদীভাঙন রোধের দাবিতে জনসংযোগ কর্মসূচি নিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেসের তদানীন্তন সভাপতি অধীর। রাজ্য সরকার নদী ভাঙন রোধে কিছুই করছে না, হাজার হাজার মানুষের জমি-বাড়ি পদ্মার গ্রাসে চলে যাচ্ছে— এই অভিযোগ তুলে মুর্শিদাবাদের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত পদযাত্রা করেছিলেন তিনি। ফল মিলেছিল হাতেনাতে। মুর্শিদাবাদ জেলা হয়ে উঠেছিল কংগ্রেসের দুর্গ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনকার রাজনৈতিক সমীকরণ সেই সময়ের চেয়ে অনেক আলাদা। এখন বিরোধী রাজনীতিতে বিজেপি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আর তৃণমূলের রাজনীতিও বামেদের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রাসী। তাই সে সময়ে যে সাফল্য অধীর পেয়েছিলেন, এ বারও তেমনই হবে, এমনটা কষ্টকল্পনা। কিন্তু সেতু বিপর্যয়কে হাতিয়ার করে রাজ্য সরকারের গায়ে ব্যর্থতার স্ট্যাম্প লাগিয়ে দিতে অধীর যে মরিয়া এবং ‘সরকারি অকর্মণ্যতা’র বিপরীতে কংগ্রেসের ‘সক্রিয়তা’র ছবি তুলে ধরতে যে তিনি সচেষ্ট, তা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।

Adhir Chowdhury Congress Bridge Collapse Majerhat Farakka Farakka Barrage TMC Mamata Banerjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy