বহরমপুর ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের সামনে অধীর চৌধুরী।
চিত্র ১: রাস্তায় জামা খুলে, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পুলিশকে গুলি চালানোর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরী। একেবারে নায়কের ভঙ্গিতে!
চিত্র ২: আলো ফোটার আগেই ভোর পৌনে পাঁচটায় কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ভবনে নিজের কার্যালয়ে পৌঁছে গেলেন মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক ওয়াই রত্মাকর রাও।
মঙ্গলবার, কংগ্রেসের ডাকা বাংলা বন্ধের দিনে এই দুই ছবি নিয়ে জমাটি তর্ক অন্য সব আলোচনাকে ছাপিয়ে গেল।
সকাল পৌনে ৯টা। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের জেলা কার্যালয়ের প্রধান ফটক আটকে কংগ্রেসের বিধায়ক ফিরোজা বেগমের নেতৃত্বে পিকিটিং করছিলেন বহরমপুর পুরসভার কয়েকজন প্রাক্তন ও বর্তমান কাউন্সিলর। নিজের কার্যালয়ে ঢোকার জন্য সেখানে এসে পৌঁছন ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের জেলা আধিকারিক তথা অতিরিক্ত জেলাশাসক অরবিন্দলাল মিনা। পুলিশ সে সময়ে লাঠিচার্জ করে প্রাক্তন ও বর্তমান মিলিয়ে তিন কাউন্সিলর-সহ কংগ্রেসের আট জনকে গ্রেফতার করে। অভিযোগ লাঠিপেটা করা হয় রানিনগরের বিধায়ক ফিরোজা বেগমকেও। অধীর চৌধুরীর কাছে সে খবর যেতেই শুধু হয় ধুন্দুমার কাণ্ড!
অধীরের প্রতিক্রিয়া, ‘‘সে কথা শোনার পরে আর চুপ থাকতে পারিনি!’’ ৯টা নাগাদ পৌঁছে যান ঘটনাস্থলে। সেখানে তখন মোতায়েন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুখেন্দুবিকাশ হীরার নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী। গাড়ি থেকে নেমেই উত্তেজিত অধীর দু’হাত দিয়ে পুলিশকে সরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের জেলা কার্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে। জামা খুলে, বুক চিতিয়ে, দু’হাত তুলে তাঁর হুঙ্কার, ‘‘আয় তোরা! পুলিশ চালা গুলি! হিম্মত থাকলে বুকে চালা গুলি! দেখি তোদের কত গুলি আছে। চালা লাঠি!’’
রণং দেহি মূর্তিতে ওই ফটকের সামনে ১১টা পর্যন্ত টানা দু’ঘণ্টা পিকেটিং করেন। এ দিকে পিকেটিং-এর কারণে নিজের কার্যালয়েই স্বয়ং জেলাশাসক না ঢুকতে পারলে নাককাটা যাবে প্রশাসনের। সেই আশঙ্কায় ভোরের আলো ফোটার আগেই পৌনে পাঁচটা নাগাদ অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) ও খাদ্য সরবরাহ নিগমের জেলা নিয়ামককে সঙ্গে নিয়ে নিজের কার্যালয়ে পৌঁছে যান জেলাশাসক। পরে সাড়ে ন’টা নাগাদ তাঁর অধীনস্থ কর্মীরা অফিস করতে গিয়ে আটকে পড়েন প্রধান ফটকের বাইরে কংগ্রেসের অবস্থানের সামনে।
তখন তাঁদের কৌশলে ঢোকানো হয় অফিসে। কেমন? সরকারি কর্মীরা প্রধান ফাটকের সামনে থেকে চলে যান জেলাশাসকের বাংলোয়। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল জানালায় লোহার জাল দেওয়া পুলিশের বেশ কয়েক’টি কালো রঙের প্রিজন ভ্যান। লাঠিচার্জ করে অবরোধ সাময়িক হঠিয়ে, সেই ভ্যানে করে ২০-২৫ জন সরকারি কর্মীকে পৌনে দশটা নাগাদ নিয়ে যাওয়া হয় প্রশাসনিক ভবনের ভিতরে। পরক্ষণেই বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে অবরোধের আকার আয়তন অনেক বড় হয়ে যায়। ফলে বাকিদের আর প্রিজন ভ্যানে করে প্রশাসনিক ভবনে পৌঁছে দেওয়ার ঝুঁকি নেয়নি প্রশাসন।
দুপুর ১২টা নাগাদ বহরমপুর শহর লাগোয়া পঞ্চানতলায় মোড়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে কংগ্রেস কর্মীরা একটা লরি ভাঙচুর করলে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। কিছু মোটরবাইক ভাঙচুর করে পুলিশ। সোওয়া বারোটা নাগাদ পিকেটিং তুলে কংগ্রেস কর্মীরা দলের জেলা কার্যালয়ের দিকে রওনা হন। এমন সময় কংগ্রেস কার্যালয় ও জেলাশাসকের কার্যালয় থেকে ঠিল ছোঁড়া দূরত্বে ওল্ড কালেক্টরেট মোড়ের সামনে এসে পড়ে কলকাতাগামী উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় নিগমের যাত্রীবাহী একটি বাস। তপন-কলকাতা ভায়া মালদহ-লালগোলা রুটের বাসটিতে তখন জনা দশেক যাত্রী। কংগ্রেস কর্মীরা যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে বাসটি ভাঙচুর করে।
এরপর সাড়ে ১২টা নাগাদ লুচি-আলুরদম খেতে রওনা দেয় দলের জেলা অফিসে। এই সুযোগে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ভবনে জেলাশাসকের কার্যালয়ে হাজিরা দিতে রওনা দেন। ইতিমধ্যে ওল্ড কালেক্টরেট মোড়ে পৌঁছয় সুখেন্দুবিকাশ হীরার নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী। এখানেই বহরমপুর পুরসভার তৃণমূল কর্মী কার্তিক চৌধুরী ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘‘পুলিশ থাকতেও সরকারি বাস ভাঙচুর হল!’’ লাঠিপেটা করে তৃণমূল কর্মীকে নিজেদের গাড়িতে তুলে নেয় পুলিশ। পরে অবশ্য তাঁকে ছেড়ে দেওয়াহয়।
এ দিন মুর্শিদাবাদের অধিকাংশ স্কুল-কলেজ, দোকান-বাজার, আদালত-ব্যাঙ্ক বন্ধ ছিল। বেসরকারি বাস রাস্তায় নামেনি। সরকারি বাস চললেও সংখ্যায় অল্প। ট্রেন চলেছে। তবে দেরিতে। জেলাসদর বহরমপুর শহর-সহ বিভিন্ন ব্লকে দুপুর সাড়ে ১২টার পর সরকারি অফিসে কর্মীরা হাজির হলেও সাধারণ মানুষের দেখা মেলেনি। লালগোলায় বন্ধের দিন কংগ্রেস মিছিল করলেও পিকেটিং করেনি। জেলাশাসক ওয়াই রত্নাকর রাও বলেন, ‘‘শতকরা সাতানব্বই ভাগ কর্মীই এ দিন হাজির হয়েছেন।’’ পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলেন, ‘‘বন্ধের ঘটনায় পঞ্চাশ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘কংগ্রেস সাইনবোর্ড বলে তাচ্ছিল্য করেন মমতা বন্দ্যোধ্যায়। তিনিই বন্ধ ব্যর্থ করতে পুলিশকে রাস্তায় নামিয়েছেন। ফলে তৃণমূলের প্রতিপক্ষ হিসাবে কংগ্রেসকে তিনি মেনেই নিলেন।’’
অন্য দিকে, বন্ধকে ঘিরে বহরমপুরের মতো উত্তেজনা ছিল না জঙ্গিপুর মহকুমার কোথাও। বিভিন্ন সরকারি অফিস, পুরসভা, সড়ক সর্বত্রই মাঝেমধ্যেই অবরোধ করেছেন কংগ্রেস সমর্থকেরা। সে ভাবে প্রতিরোধের ছবি দেখা যায়নি কোথাও। সকালে নিমতিতায় আধ ঘণ্টার জন্য অবরোধে আটকে পরে হাওড়াগামী ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস। ভাগীরথী সেতু, মোরগ্রাম সেতু, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধলার মোড়, ডাকবাংলো মোড়, আহিরণ সর্বত্রই অবরোধ করেন কংগ্রেস কর্মী, সমর্থকেরা।
কংগ্রেস পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব নিজেই রঘুনাথগঞ্জে সড়ক অবরোধে বসে পড়েন। বাস বন্ধ ছিল সর্বত্রই। তবে ছোট গাড়ি চলেছে। সাগরদিঘিতে বন্ধের প্রভাব ছিল না বললেই চলে। সুতির বিড়ি শিল্পাঞ্চলে কাজ হয়নি। তবে বহু ডাকঘর এ দিন খোলা ছিল। রঘুনাথগঞ্জে দফায় দফায় প্রায় জনা তিরিশেক কর্মী-সমর্থককে গ্রেফতার করে পুলিশ। আহিরণে গ্রেফতার হন কংগ্রেসের ব্লক সভাপতি রজত দাস, জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ আশিস তেওয়ারি-সহ ছয় বন্ধ সমর্থক। বেলা দেড়টা নাগাদ ছেড়ে দেওয়া হয় সকলকেই।
এ দিন দিনভর দফায়-দফায় পুলিশ ও কংগ্রেস কর্মীদের ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটল কান্দির পাঁচটি ব্লকে। সকালে প্রথম ঘটনা ঘটে বড়ঞা থানা এলাকার কান্দি-সাঁইথিয়া রাজ্য সড়কের উপরে কুলির মোড়ে। পুলিশের নিষেধ উপেক্ষা করে কয়েক’শো কংগ্রেস কর্মী রাজ্য সড়ক অবরোধ শুরু করে। কান্দি থানা এলাকার বহরমপুর-সাঁইথিয়া রাজ্য সড়কের উপর কন্যানপুর মোড় ও পুরন্দরপুর মোড় এলাকায় দু’টি সরকারি বাসের সামনে ইট ছুঁড়ে দু’টির বাসের সামনের কাঁচ ভেঙে দেয় কংগ্রেস কর্মীরা। বড়ঞা ব্লক অফিস বন্ধ করতে গিয়ে বন্ধ সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি হয়। কান্দি মহকুমাশাসকের দফতরের সামনেও বন্ধ সমর্থকদের বিক্ষোভের জেরে অধিকাংশ কর্মীদের অফিসে না ঢুকে দূরে একটি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। ভরতপুর বাজারে বন্ধের সমর্থনে কংগ্রেস কর্মীদের মিছিল থেকে এক ব্যবসায়ীর দোকানে ঢিল ছোঁড়া হয় বলে অভিযোগ।
ছবি: গৌতম প্রামাণিক ও অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy