E-Paper

বাইরের ক্ষতে সজ্জার প্রলেপ, পুরনো সুর মমতার

মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জ, ধুলিয়ান, সুতির অকুস্থলের ভোলই বদলে ফেলছে প্রশাসন! সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা এলাকায় মঙ্গলবার পা রাখার কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২৫ ০৬:৪০
জাফরাবাদে নিহত বাবা-ছেলের বাড়ির ভাঙা দরজায় রাতারাতি বসেছে নতুন প্লাইউড।

জাফরাবাদে নিহত বাবা-ছেলের বাড়ির ভাঙা দরজায় রাতারাতি বসেছে নতুন প্লাইউড। —নিজস্ব চিত্র।

রাস্তা সারাই করে গর্ত, খানা-খন্দ বুজিয়ে ফেলা হয়েছে কোথাও। নরম মাটিতে এনে ফেলা হয়েছে পাথরকুচি। সরকারি কোনও বাড়ি থাকলে তার গায়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় নীল-সাদার পোঁচ পড়ছে। হামলার ক্ষত ছড়িয়ে থাকা গলিতে এখন ব্লিচিং পাউডার, পাশে কাঁটাতারের বেড়া! আক্রান্ত বাড়ি থেকে পোড়া, ভাঙা আসবাব বার করে রেখে দেওয়া হয়েছে সংলগ্ন মাঠে। হামলায় ভেঙে যাওয়া নিহত বাবা-ছেলের বাড়ির দরজায় আবার এক রাতে বসিয়ে ফেলা হয়েছে প্লাইউড!

মুর্শিদাবাদের শমসেরগঞ্জ, ধুলিয়ান, সুতির অকুস্থলের ভোলই বদলে ফেলছে প্রশাসন! সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা এলাকায় আজ, মঙ্গলবার পা রাখার কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কেন্দ্রের সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদ ঘিরে অশান্তির জেরে এলাকার যে চেহারা সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি-সহ বিরোধী দলের নেতারা দেখে গিয়েছেন, তার সঙ্গে এখনকার ছবির তফাত চোখে পড়ার মতোই। ঘটনাস্থলে দ্রুত ছুটে যাওয়া এবং আক্রান্তের পাশে দাঁড়ানো যে তৃণমূল নেত্রীর রাজনীতির বরাবরের মূল মন্ত্র, প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে তাঁর সফরের আগে এলাকার এমন ‘সাজ-সজ্জা’ বিস্ময় জাগাচ্ছে নানা মহলেই!

অশান্তির তিন সপ্তাহ পরে সোমবারই মুর্শিদাবাদ জেলায় পৌঁছেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। বহরমপুরে দাঁড়িয়ে ফের তিনি ঘটনার জন্য বিএসএফের দিকে আঙুল তুলেছেন, ‘পূর্ব পরিকল্পনা’র অভিযোগও করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মুর্শিদাবাদ জেলাকে কেন্দ্র করে মাত্র দু’টো ওয়ার্ডে গন্ডগোল হয়েছে। সেটাও কারা করেছেন, পরিকল্পনা করে কী ভাবে করিয়েছেন, এই ক’টা দিন ধরে আমি অনেক ‘ক্রস চেক’ করেছি, রেকর্ডও করেছি। আর কিছুটা আমার বাকি আছে। পেয়ে গেলে সংবাদমাধ্যমের সামনে আসবে।’’ মুখ্যমন্ত্রী দু’টো ওয়ার্ডের কথা বললেও অশান্ত এলাকার মধ্যে যে পঞ্চায়েত অঞ্চলও আছে, স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বিরোধীরা।

সুতির কাশিমনগরে গুলিতে নিহত যুবকের বাড়িতে নেই প্রশাসনের কোনও নজর বা নজরদারি।

সুতির কাশিমনগরে গুলিতে নিহত যুবকের বাড়িতে নেই প্রশাসনের কোনও নজর বা নজরদারি। —নিজস্ব চিত্র।

মুখ্যমন্ত্রীর আরও বক্তব্য, ‘‘দু-তিন জন গোলমাল পাকিয়েছে। আর আমি গাল খাচ্ছি! কেন? আমি কি কাউকে বলেছি কেউ কারও বিরুদ্ধে হামলা করুন। বিএসএফ-ই বা কেন গুলি চালিয়েছিল? বিএসএফ যদি গুলি না চালাত, পরের দিন ঘটনা ঘটত না— এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’’

কলকাতা থেকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী পাল্টা বলেছেন, গোলমাল থামাতে বিএসএফ গুলি চালিয়ে থাকলে সেটা আইন অনুযায়ী কমিশন দেখবে। তবে তাঁর দাবি, ‘‘আপনি ১৪ বছরের পুলিশমন্ত্রী। পুলিশকে ডেকেও ওই পরিবারগুলো সাহায্য পায়নি। পুলিশ ব্যর্থ হলে আপনাকে গালাগালি দেবে না তো কাকে দেবে? বিএসএফ না থাকলে মৃতের সংখ্যাটা দুইয়ের অনেক বেশি হত।’’

জেলায় এসে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভ আরও বেড়েছে জাফরাবাদে নিহত বাবা-ছেলের পরিবারের সকলেই এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায়। দুই নিহতের স্ত্রী বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর তত্ত্বাবধানে এ দিনই কলকাতা হাই কোর্টে আবেদন করেছেন সিবিআই তদন্ত চেয়ে। বাবা ও দাদাকে হারানো যুবকও সপরিবার কলকাতা চলে গিয়েছেন। যার প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘আমি না হয় দু’টো পরিবারের সঙ্গে দেখা করে ১০ লক্ষ টাকা করে তাদের হাতে তুলে দিতাম। আপনারা (বিজেপি) লুকিয়ে নিয়ে গেলেন কেন? এটা অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া নয়? কালকে তাদের দিয়ে আমাকে খুব গালাগালি দিয়েছেন, দিন না! আমায় গালাগালি দিলে আমার গায়ে ফোস্কা পড়বে না।’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘আমি যেতে চেয়েছিলাম ওদের বাড়ি। আমার কোনও দোষ নেই। কিন্তু তাদের লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কেন? প্রশ্ন থাকবে— ডাল মে কুছ কালা হ্যায়?’’

বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর পাল্টা দাবি, ‘‘সাচ্চা হিন্দু কেউ ওঁর ক্ষতিপূরণ নেবে না। সবাই মনে করে, আপনি এই হত্যার জন্য দায়ী। ওদের যা ক্ষতি হয়েছে তার কোনও পূরণ হবে না।’’ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য অধীর চৌধুরী মুর্শিদাবাদে মানুষের কাছে মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন।

এই বিতর্কের কোনও আঁচই পৌঁছয়নি সুতির কাশিমনগরের এক বাড়িতে। স্বামীকে হারিয়ে দু’বছরের সন্তান আরোহীকে নিয়ে যেখানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দিন কাটছে এক তরুণীর। পুলিশের গুলিতে এক জনের মৃত্যু হয়েছে বলে এ দিনও উল্লেখ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, তাঁর বলা দুই পরিবারের একটির বাস এখানেই। অথচ গুলিতে প্রাণ হারানো ২১ বছরের তরুণের বাড়ির এলাকায় প্রশাসনের তৎপরতার লেশমাত্রও চোখে পড়েনি এ দিন বিকালে। দরজায় এসে নিহতের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বোন রিঙ্কু বলে গিয়েছেন, ‘‘অধীর চৌধুরী, মহম্মদ সেলিম, খলিলুর রহমানেরা এসেছিলেন। পুলিশ-প্রশাসনের কেউ এসে কথা বলেনি আমাদের সঙ্গে।’’ প্রশাসনিক সূত্রের খবর, সুতির বিডিও অফিসে আর্থিক ক্ষতিপূরণ নিতে নিহত তরুণের বাবাকে ডাক পাঠানো হয়েছে তেহট্টের নিহত জওয়ানের পরিবারের পাশাপাশিই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Murshidabad Mamata Banerjee

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy