দিন কুড়ি হল মেডিক্যালে ভর্তির সময়সীমা পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওরা এখনও সক্রিয়।
ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তরপ্রদেশের একাধিক মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির ‘গ্যারান্টি’ দিচ্ছে ওরা। লাখ চল্লিশ টাকার বিনিময়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির ছাপানো অনুমোদনপত্রও দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তা নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা যখন সংশ্লিষ্ট মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে যাচ্ছেন, দেখা যাচ্ছে অনুমোদনপত্রটি জাল। এ ভাবে ভর্তি গিয়ে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীকে নাকাল হতে হয়েছে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে। বিষয়টি স্বাস্থ্য ভবনকে জানানোর পাশাপাশি পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেছে ওই তিনটি মেডিক্যাল কলেজ। যদিও প্রতারকদের কাউকেই এখনও ছুঁতে পারেনি পুলিশ।
জয়েন্ট এন্ট্রান্স ও নিট-এ উত্তীর্ণ হতে পারেননি এমন অনেক প্রার্থীর মোবাইলেই একটি নির্দিষ্ট নম্বর থেকে ফোন আসছিল গত মাসে। ওই নম্বরে যোগাযোগ করে অনেকেই টাকা দিয়ে ভর্তির অনুমোদনপত্র তুলে প্রতারিত হয়েছেন। সেই প্রতারণাচক্র যে রাজ্য জুড়ে এখনও সক্রিয়, তার প্রমাণ মিলল গত রবিবারেই। নম্বরটিতে ফোন করায় এক পুরুষকন্ঠ হিন্দিতে জানায়, ‘‘কলকাতায় হবে না, তবে মেদিনীপুর বা বর্ধমানে হয়ে যাবে। এর জন্য চেকে অগ্রিম দিতে হবে ৮ লক্ষ টাকা। নগদে ১৪ হাজার টাকাও লাগবে।’’ বলা হয়, ভর্তির দু’টো শর্ত আছে। আবেদনকারীকে নিট-এ বসতেই হবে এবং উচ্চ মাধ্যমিকে অন্তত ৮০% পেতে হবে।
কিন্তু ৩০ সেপ্টেম্বর তো দেশ জুড়ে মেডিক্যালে ভর্তির সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছে। এখন কি আর নতুন করে ভর্তি সম্ভব? ফোনের অন্য প্রান্তের পুরুষকণ্ঠের জবাব, ‘‘টাকা থাকলে আর দু’টি শর্ত মিলে গেলে ভর্তি হওয়াটা কোনও ব্যাপার নয়।’’ একটি ই-মেল ঠিকানা দিয়ে সমস্ত কাগজপত্র পাঠিয়ে দিতেও বলা হয়।
এ ভাবে এখন ভর্তি হওয়া সম্ভব কি না, জানতে ফোন করা হয়েছিল স্বাস্থ্য ভবনে। স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগের স্পেশ্যাল সেক্রেটারি তমাল ঘোষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই ভাবে ভর্তি-জালিয়াতি চলছে বেশ কিছু বছর ধরেই। তমালবাবু মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের পদে ছিলেন ক’মাস আগেও। বললেন, ‘প্রতি বছর এ রকম ভর্তির জাল নথি নিয়ে রাজ্যের এমনকী দেশের নানা প্রান্ত থেকে পড়ুয়ারা বিভিন্ন
মেডিক্যাল কলেজে চলে আসছে। কোনও চিঠিতে ছাপার হরফে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের নাম, কোনওটায় বা স্বাস্থ্য মন্ত্রকের নাম থাকছে। জাল স্ট্যাম্প আর সই-ও থাকছে। ‘প্রভিশনাল অ্যাডমিশন লেটার’ হিসেবে যে কাগজপত্র দেওয়া হয়েছে তার জন্য ৩০ হাজার থেকে শুরু করে ৩০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত এক এক জনের থেকে নেওয়া হয়েছে।’’
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে চলতি বছরে জাল নথি নিয়ে এমবিবিএস-এ ভর্তি হতে এসেছেন ১৮ জন। বুধবার অর্থাৎ ১৯ অক্টোবরও এ রকম দুই পড়ুয়া এসেছেন। এক জনের বাড়ি জলপাইগুড়ি, অন্য জনের হুগলি। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সুকুমার বসাক জানান, প্রতারকেরা বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের ভুয়ো ওয়েবসাইট তৈরি করে মেডিক্যাল পড়তে ইচ্ছুকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা নিচ্ছে এবং ভুয়ো চিঠি ধরাচ্ছে। তাঁর অভিযোগ, নীরজ পাণ্ডে ও প্রদীপ ঘোষ নামে দু’জন এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। এঁদের বিস্তারিত তথ্য পুলিশকে জানিয়ে এফআইআরও করা হয়েছে। সুকুমারবাবুর কথায়, ‘‘কেরল, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র থেকেই বেশি পড়ুয়া এই নকল নথি নিয়ে ভর্তি হতে আসছেন। একাধিক বার পুলিশ-প্রশাসনকে জানিয়েছি।’’
বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের নামের যে ভুয়ো ওয়েবসাইটগুলি ইন্টারনেটে মিলছে তার একটিতে দেওয়া নম্বরে ফোন করা হয় বুধবার। জানা যায়, এখন পশ্চিমবঙ্গে ভর্তির সমস্যা রয়েছে। তবে মেডিক্যাল পড়তে আগ্রহী পড়ুয়া নিট-এ বসে থাকলে এবং ৪২ লক্ষ টাকা নগদ দিলে উত্তরপ্রদেশের শাহজাহানপুরের বরুণ-অর্জুন মেডিক্যাল কলেজে, ৫০ লক্ষ নগদ দিলে হাপুরের সরস্বতী ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল
সায়েন্সেসে বা লখনউয়ের জিসিআরজি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএসে ভর্তি করা যাবে।
আরও একটি নম্বরে ফোন করলে নিজেকে বিষ্ণু ত্রিপাঠি বলে পরিচয় দিয়ে এক জন জানান, ৪৫ লক্ষ টাকার চেক আর তাঁকে নগদ এক লক্ষ টাকা দিলেই উত্তরপ্রদেশের বরেলিতে রাজশ্রী মেডিক্যাল
কলেজে এমবিবিএসে ভর্তি হওয়া নিশ্চিত। এবং সেটা দীপাবলির আগেই। একটাই শর্ত। পড়ুয়াকে শুধু নিট-এ বসতে হবে।
মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই) এ ব্যাপারে কি করছে? এমসিআই-য়ের প্রধান জয়শ্রী বেন মেহতা বলেন, ‘‘দেশ জুড়ে এমবিবিএস-এ ভর্তি নিয়ে বিভিন্ন রকম জুয়োচুরি হচ্ছে। আমরা সংশ্লিষ্ট সরকারকে সবই জানাচ্ছি। ওইটুকুই আমাদের ক্ষমতা। বাকিটা ওই সরকারের দায়িত্ব।’’
কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর এই ধরনের প্রতারণা রুখতে নিজেরা কোনও ব্যাবস্থা নিতে পারে না? স্বাস্থ্য-শিক্ষা বিভাগের স্পেশ্যাল সেক্রেটারি বলেন, প্রত্যেক বছর একই ঘটনা ঘটছে বলে স্বাস্থ্য দফতর এমবিবিএস-এ ভর্তির আগে এই প্রতারণা নিয়ে ব্যাপক হারে বিজ্ঞাপন এবং সচেতনতা অভিযানের পরিকল্পনা করছে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে। পুলিশের কাছে স্বাস্থ্য
দফতরের আর্জি, প্রতারকদের খুঁজে বার করে কড়া শাস্তি দিলেই এই ধরনের ঘটনা কমতে পারে। রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন, প্রতারকদের ধরতে তদন্ত চলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy