যাবতীয় জল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত বদলিই করে দেওয়া হল বাঁকুড়া সদর থানার আইসি বিশ্বজিৎ সাহাকে। মঙ্গলবারই থানায় নতুন আইসি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন রাজর্ষি দত্ত। তিনি মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের কোর্ট ইনস্পেক্টর পদে ছিলেন। বুধবার রাতে প্রাক্তন আইসি বিশ্বজিৎবাবুকে বিদায়ী সংবর্ধনা দেয় বাঁকুড়া পুলিশ। কিন্তু, তাঁর বদলি নিয়ে চাপা ক্ষোভ জেলা পুলিশ মহলে।
গত ৯ জুন বাঁকুড়ার গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দুর্গাপুরের এক বধূর শ্লীলতাহানি করার অভিযোগ ওঠে যুব তৃণমূল নেতা পীযূষ চক্রবর্তী ওরফে ক্যাসেট বাপির বিরুদ্ধে। পুলিশ ওই বধূ ও তাঁর স্বামীকে উদ্ধার করতে গেলে সদর থানার সাব ইন্সপেক্টর ক্ষিতীশ পাইনকে বাপি মারধরের করে তাঁর মোবাইল ভেঙে দেন বলেও অভিযোগ। বাঁকুড়া পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলরের স্বামী বাপিকে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করে পুলিশ। এই ঘটনার পরেই বাপির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন জেলা তৃণমূল নেতারা। আর গ্রেফতারের দিন সন্ধ্যাতেই বাঁকুড়া থেকে হুগলি জেলা গোয়েন্দা বিভাগ বা ডিআইবি-তে বদলির নির্দেশ হাতে পান বিশ্বজিৎবাবু। এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক দানা বাঁধে জেলার পুলিশ মহলে।
জেলার পুলিশ কর্তাদের নির্দেশেই বাপিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অথচ তার পরেও কেন আইসি-কে বদলি করা হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন নিচুতলার পুলিশকর্মীদের একাংশ। পুলিশ সূত্রে খবর, আইসি-র বদলির প্রতিবাদে সরব হয়ে জেলার পুলিশ কর্তারা শীর্ষ আধিকারিকদের কাছেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। পুলিশ কর্তাদেরই অনেকে দাবি করেছিলেন, নিচুতলার ক্ষোভের মুখে পড়ে আইসি-র বদলির নির্দেশে স্থগিতাদেশ দেওয়ার চিন্তা করছেন পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ মহল। এক পুলিশ কর্তা সাফ বলেছিলেন, “আমাদের আইসি কোথাও যাচ্ছেন না।’’ জেলার আইনজীবী মহল থেকে রাজনৈতিক মহল, সর্বত্রই বিষয়টি নিয়ে জল্পনা দানা বাঁধে। শেষ অবধি অবশ্য তা জল্পনার স্তরেই থেকে গিয়েছে। আইসি-র বদলি রদ হয়নি।
আর তার জেরে চাপা ক্ষোভ ঝরে পড়েছে বাঁকুড়ার পুলিশকর্মীদের গলায়। যদিও শাস্তির খাঁড়া নেমে আসার ভয়ে কেউই প্রকাশ্যে মুখ খুলতে পারছেন না। পুলিশ সূত্রে খবর, বিশ্বজিৎবাবুর বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও একাধিক পুলিশকর্মী বলেছেন ‘এ ভাবে আইসি-র চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না’। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাঁকুড়া সদর থানায় আইসি যোগ দিয়েছিলেন বিশ্বজিৎবাবু। বেশ কিছু ঘটনায় তাঁর সক্রিয়তার জন্য তিনি জেলা তৃণমূলের কোপের মুখে পড়েছেন। কিছু ঘটনায় তাঁকে কড়া পদক্ষেপ করতে দেখা গিয়েছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। বছর খানেক আগেই লালবাজারে একটি সন্তোষী পুজো কমিটির ভাসানে মাইক আটক করাকে কেন্দ্র করে পুজো কমিটির লোকজনের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয় বিশ্বজিৎবাবুকে। তাতে দমে না গিয়ে বেশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করেছিলেন তিনি। এই ঘটনার পর থেকে কালীপুজো বা সরস্বতী পুজোর মতো অনুষ্ঠানগুলিতে শব্দ দূষণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল।
সম্প্রতি শহরের গোপীনাথপুরে একটি হরিনাম সংকীর্তনকে কেন্দ্র করে মাঝরাতে তারস্বরে মাইক বাজিয়ে নাচগানের অনুষ্ঠান চলছিল। আইসি-র নেতৃত্বে পুলিশ গিয়ে মাইক খুলে নিয়ে আসে। এর প্রতিবাদে থানায় চড়াও হয় স্থানীয় যুবকেরা। পুলিশ কয়েক জনকে আটকও করেছিল। ঘটনার খবর পেয়ে মাঝরাতেই থানায় এসে ধৃতদের ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী। তবে শব্দদানবে লাগাম টানতে বাঁকুড়া পুলিশের কড়া মনোভাবের বার্তা যায় শহরবাসীর কাছে।
পুরসভা ভোটেও বাঁকুড়া শহরে বুথে বুথে কড়া নজর রেখেছিলেন বিশ্বজিৎবাবু। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে বেরিয়ে কাজ করতে দেখা গিয়েছিল বিশ্বজিৎবাবুকে। আর সে কারণেই দেড় বছরের মধ্যে বাঁকুড়া সদর থানা থেকে তাঁকে বিদায় নিতে হল বলেই মনে করছেন পুলিশকর্মীদের একাংশ। জেলা পুলিশেরই এক পদস্থ আধিকারিকের কথায়, “বাপিকে গ্রেফতারের আগে পুলিশ কর্তাদের আনুমতি নিয়েছিলেন আইসি। তা-ও তাঁর উপরেই কোপ পড়ল! এই ঘটনায় এটাই প্রমাণ হল শীর্ষ কর্তাদের নির্দেশে পদক্ষেপ নিলেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে অধস্তন কর্মীদেরই।’’ একই সঙ্গে ওই কর্তার আক্ষেপ, “আমাদের হাতে আসলে কোনও ক্ষমতাই নেই। আইসি-র বদলি সেই বার্তাই দিল।’’ জেলার একটি থানার ওসি বলেন, “হাত গুটিয়ে বসে থাকলে জনতা আর সংবাদমাধ্যম আমাদের তুলোধোনা করবে। আবার পদক্ষেপ নেওয়াও দায়। বিশেষ করে শাসক দলের বিরুদ্ধে কিছু করলেই শাস্তির খাঁড়া ঝুলবে মাথায়! তাই ক্ষোভ যতই থাক, তা আমরা মনের মধ্যেই রাখি। বাইরে আনার উপায় নেই।’’
বুধবার রাতে বিশ্বজিৎবাবুর বিদায়ী সংবর্ধনায় এক পুলিশকর্মী তাই বলেই ফেলেছিলেন, “এ ভাবে আইসি সাহেবকে চলে যেতে হবে ভাবতে পারিনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy