Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

বেড়েই চলেছে বিক্ষোভ, দল বড় হচ্ছে, ব্যাখ্যা বিজেপির

পুরভোট যত এগিয়ে আসছে, বিজেপি-র সংগঠনে অগোছালো দশা ততই যেন প্রকট হচ্ছে! রাজ্যে লোকসভা ভোটের সময় থেকে বিরোধী রাজনীতির পরিসর দখল করার লক্ষ্যে যারা দ্রুত এগিয়ে আসছিল, পুরভোটের মুখে তারাই এখন নানা কলহ এবং বিক্ষোভে জেরবার! বিজেপি নেতাদের অবশ্য যুক্তি, দলের শক্তি বাড়ছে বলেই প্রার্থী হতে আগ্রহীদের সংখ্যা বেড়েছে। যাঁরা টিকিট পাচ্ছেন না, তাঁদের দু’এক জন বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৫ ০৩:২৮
Share: Save:

পুরভোট যত এগিয়ে আসছে, বিজেপি-র সংগঠনে অগোছালো দশা ততই যেন প্রকট হচ্ছে! রাজ্যে লোকসভা ভোটের সময় থেকে বিরোধী রাজনীতির পরিসর দখল করার লক্ষ্যে যারা দ্রুত এগিয়ে আসছিল, পুরভোটের মুখে তারাই এখন নানা কলহ এবং বিক্ষোভে জেরবার! বিজেপি নেতাদের অবশ্য যুক্তি, দলের শক্তি বাড়ছে বলেই প্রার্থী হতে আগ্রহীদের সংখ্যা বেড়েছে। যাঁরা টিকিট পাচ্ছেন না, তাঁদের দু’এক জন বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।

সেই বিক্ষোভের রেশ অবশ্য ছড়িয়েছে গোটা রাজ্যে। গত দু’দিনের মতো সোমবারও জেলায় জেলায় বিজেপি-র প্রার্থী তালিকা নিয়ে অসন্তোষ ও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ‘স্বজনপোষণে’র অভিযোগ এনেছেন বিক্ষু্ব্ধেরা। দলীয় সূত্রের খবর, বীরভূমের জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের মতোই সোনারপুর-রাজপুর পুরসভার প্রার্থী তালিকা নিয়ে অসন্তোষের জেরে ইস্তফা দিয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সভাপতি (পূর্ব) দেবতোষ আচার্য।

খড়্গপুর শহরে বিজেপি কর্মীদের বিক্ষোভে রীতিমতো দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কুশপুতুল পোড়ানো হয়েছে। অভিযোগ, দলের পুরনো কর্মীদের পরিবর্তে টিকিট পেয়েছেন সদ্য বিজেপি-তে আসা লোকজন। অবিলম্বে প্রার্থী তালিকা সংশোধন করা না-হলে রেল-শহরের ৩৫টি ওয়ার্ডেই নির্দল হিসেবে লড়াই করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন বিক্ষুব্ধেরা। সর্বত্র কুশপুতুল দাহ না হলেও কম-বেশি বিক্ষোভের খবর এসেছে নানা জেলা থেকেই।

দক্ষিণপন্থী এবং সভাপতি-কেন্দ্রিক দলে ক্ষোভ-বিক্ষোভের এমন ছবিই পরিচিত। কিন্তু কংগ্রেস বা তৃণমূলের তুলনায় বিজেপি-র খ্যাতি বেশি শৃঙ্খলাবদ্ধ দল হিসাবেই। সেখানে এমন বিক্ষোভের ছবি স্বভাবতই বিজেপি নেতৃত্বের বাড়তি অস্বস্তির কারণ হচ্ছে। তা ছাড়া, ভোটপ্রাপ্তির হার বাড়লেও সংগঠন গড়ে না উঠলে যে দল ধরে রাখা কঠিন, গত কয়েক মাসে বিজেপি-র ভিতরে-বাইরে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। এখন পুরভোটের মুখে এসে দেখা যাচ্ছে, সংগঠন ঠিকমতো গড়ে ওঠার আগেই বিক্ষোভের চোটে দিশাহারা অবস্থা!

দলের রাজ্য সভাপতি রাহুলবাবু অবশ্য এ দিনও দাবি করেছেন, “বিক্ষোভ দল বড় হওয়ার লক্ষণ! সাধারণ মানুষ এবং কর্মীদের প্রত্যাশার প্রমাণ।” কিন্তু এই বিশৃঙ্খলা কি কাম্য? রাহুলবাবুর জবাব, “বিশৃঙ্খলা কাম্য নয়। কিন্তু বিজেপি যে ভাবে বাড়ছে, সে ভাবে সংগঠনকে ধরার সময়ই পাচ্ছি না। একটার পর একটা ভোটে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। এই পুরভোটের পর আগামী বছর বিধানসভা ভোটের আগে অনেকটা সময় পাওয়া যাবে। তখন সংগঠনটাকে একটা বাঁধনের মধ্যে আনার চেষ্টা করব।” রাহুলবাবুর আরও ব্যাখ্যা, কোনও ওয়ার্ডে ২০ জন প্রার্থী হওয়ার জন্য আবেদন করে থাকলেও টিকিট পাবেন এক জনই। বাকিদের মধ্যে ক্ষোভ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাকি ১৯ জনই বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন না। দু’-তিন জন গোলমাল করছেন। সেটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কাজ নয়। যদিও দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, “পুরভোটে শাসক দল হিসাবে তৃণমূলই এগিয়ে থেকে শুরু করছে। সেখানে বিরোধী হিসাবে আমাদের দলের প্রার্থী হওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি হচ্ছে, এটা এক দিকে স্বস্তির কারণ হতে পারে। কিন্তু যে ভাবে বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছে, তাতে বার্তা যাচ্ছে যে, কর্মী-সমর্থকদের উপরে দলের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই!”

বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতির দিকে এগোনোর পথ নিয়েও বিজেপি-তে দু’রকম মত আছে। একাংশের বক্তব্য, স্থানীয় বিষয় ধরে আন্দোলন এবং সংগঠন গড়ে তুলতে না-পারলে শুধু সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে বেশি দূর এগোনো সম্ভব নয়! অন্য অংশের আবার বক্তব্য, সংগঠন গড়ার লোক তো রাতারাতি জন্মাবে না! অন্যান্য দল থেকে যাঁরা আসবেন, তাঁদের মধ্যে থেকেই বাছবিচার করে নিজেদের সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। পুরভোটের মুখে জেলায় জেলায় যে ছবি উঠে আসছে, তা থেকে স্পষ্ট অতিরিক্ত সংবাদমাধ্যম-নির্ভরতা এবং অন্য দল থেকে আসা লোকজনকে বেশি গুরুত্ব, এই দুইয়ের মধ্যে কোনও ভারসাম্য না রাখতে পেরে সমস্যা আরও জটিল হয়েছে!

লোকসভা ভোটের সময় থেকে বীরভূম জেলাতেই সব চেয়ে দ্রুত জমি তৈরি করছিল বিজেপি। এখন সেই জেলাতেই তাদের সঙ্কট ঘনীভূত! রাজ্য নেতৃত্বের প্রতি অসন্তোষ জানিয়ে রবিবারই পদত্যাগ করেছিলেন দলের জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল। সিউড়িতে দলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা ভন্ডুল হয়ে গিয়েছিল কর্মী-সমর্থকদের তুমুল বিক্ষোভের জেরে। দুধকুমারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এ দিন পদত্যাগ করেছেন জেলার আরও কিছু বিজেপি নেতা। ময়ূরেশ্বরের কোটাসুরের দলীয় কার্যালয়ে দিনভর ছিলেন দুধকুমার। সেখানে দলে দলে নেতা-কর্মীরা এসে তাঁর প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। অনেকে পদত্যাগ করার হুমকিও দিয়েছেন। রাজ্য সভাপতির পদত্যাগ দাবি করে বিক্ষোভ হয়েছে। দুধকুমারও দলীয় নেতৃত্বের প্রতি আক্রমণ বজায় রেখেছেন।

বিজেপি রাজ্য নেতৃত্ব অবশ্য দুধকুমারের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত নেননি। রাহুলবাবু স্বীকার করে নিয়েছেন, “দলের কোনও নেতা এ ভাবে পদত্যাগপত্র দিলে জনমানসে প্রশ্ন ওঠে বৈকি! মানুষের কাছে ভুল বার্তাই যায়। কিন্তু আমরা সমস্যাটা সামলানোর চেষ্টা করছি। আশা করি, পারব।” তবে রাহুলবাবুর বক্তব্য, প্রার্থী বাছাই নিয়ে ক্ষোভের জেরে দুধকুমার পদত্যাগ করেননি। তাঁর বক্তব্য, “ওঁর ক্ষোভের অনেক কারণ আছে। প্রার্থী বাছাই তার মধ্যে একটা ছোট কারণ হতে পারে। অন্য কারণগুলি সংবাদমাধ্যমকে এখন জানানো সম্ভব নয়।”

দুধকুমারের ইস্তফা ঘোষণার পরেও প্রার্থী তালিকা নিয়ে কিন্তু বীরভূমে দলের অবস্থা ছন্নছাড়াই! বিক্ষোভের আঁচ পেয়ে সিউড়ি, সাঁইথিয়া ও বোলপুর পুরসভার প্রার্থী তালিকা ঘোষণা স্থগিত রেখেছেন নেতৃত্ব। কিন্তু তালিকার অপেক্ষা না-করেই দলের নেতা-কর্মীরা মনোনয়নপত্র তোলা বা জমা দেওয়া শুরু করে দিয়েছেন! সিউড়িতে জেলা সংখ্যালঘু ভবনে এ দিন বিজেপি-র দু’জন নিজেদের মনোনয়ন তোলেন। বোলপুরেও আবার ১৪টি ওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন তুলেছেন বিজেপি-র নেতা-কর্মীরা।

পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না পাওয়ায় বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর কর্মীদের হাতে এ দিন হেনস্থা হয়েছেন বিজেপির মুর্শিদাবাদ জেলা সভানেত্রী মালা ভট্টাচার্য, জেলা মুখপাত্র সুভাষ মণ্ডলেরা। বিক্ষুব্ধেরা সভানেত্রীর হাত থেকে নিয়ে প্রার্থী তালিকা ছুড়ে ফেলে দেন। এর জেরে বিজেপি-র প্রার্থী তালিকা প্রকাশ অনুষ্ঠান মাঝপথেই থমকে যায়! দলের জেলা মুখপাত্র তথা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মণ্ডলের দিকে সরাসরি টাকা নিয়ে প্রার্থী বদল করার অভিযোগ তোলেন বিক্ষুব্ধেরা। সুভাষবাবু অবশ্য বলেন, “রাজ্য কমিটির অনুমোদন পাওয়া প্রার্থীদেরই মনোনীত করা হয়েছে।”

মালদহেও এ দিন সকালে বিজেপি-র জেলা কার্যালয়ে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা হতেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন কর্মী-সমর্থকদের একাংশ। তাঁরা কার্যালয়ের ভিতরেই হট্টগোল বাধান। নেতা-কর্মীদের একাংশ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যান। জেলা নেতাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে ইস্তফা দেন ইংরেজবাজার পুরসভার ১১ নম্বর ওর্য়াড কমিটির সভাপতি-সহ সদস্যেরা। কলকাতায় দলের রাজ্য সদর দফতরেও সহ-সভাপতি প্রভাকর তিওয়ারিকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন দক্ষিণ দমদম পুরসভার ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কর্মীরা। তাঁদেরও অভিযোগ, টাকার বিনিময়ে অযোগ্য লোকেদের প্রার্থী করা হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE