উত্তর দিনাজপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
নকল তুলাইপাঞ্জির মিশেলে যেন কোণঠাসা হওয়ার উপক্রম আসলের। তাই নকল তুলাইপাঞ্জি ধান রুখতে আসরে নেমেছে কৃষি দফতর।
উত্তর দিনাজপুরের মোহিনীগঞ্জের তুলাইপাঞ্জি চালের নামডাক তার স্বাদ ও গন্ধের জন্য। কিন্তু সম্প্রতি এক সরকারি সমীক্ষায় ধরা পড়েছে তুলাই ধানের বীজের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে একই রকম দেখতে এক বীজ, যা থেকে তুলাইয়ের মতো দেখতে ধান হলেও গন্ধে-স্বাদে তুলনায় আসে না।
তুলাইপাঞ্জির মান ও গন্ধ নিয়ে গত কয়েক বছর প্রশ্ন ওঠায় উত্তর দিনাজপুর জেলা কৃষি বিভাগ তুলাই পাঞ্জির পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করে।
প্রাথমিক পরীক্ষায় তুলাইয়ের মতো দেখতে কিছু অন্য ধানের চারার সন্ধান মেলে। পরে দেখা যায়, ভিন-প্রজাতির চারা থেকে বেরনো গাছের উচ্চতা তুলাইপাঞ্জির থেকে কম। সে গাছ থেকে তুলাইয়ের পরিচিত সুবাস মিলছে না। সমীক্ষার জন্য চাষ করা ধানের পরিমাণ ১১ কুইন্টাল। কৃষি দফতর সূত্রের খবর, সমস্ত রকম পরীক্ষা করার পরে তা থেকে মাত্র এক কুইন্টাল বিশুদ্ধ তুলাইপাঞ্জি ধান পাওয়া গিয়েছে। সে ধানের বীজ আবার বপন করা হয়েছে জমিতে। পরবর্তী কালে ওই বীজ জেলার তুলাই-চাষিদের দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে কৃষি দফতর।
দীর্ঘ দু’দশক একটানা তুলাই চাষ করে চলেছেন গৌরশঙ্কর দাস।তাঁর অভিজ্ঞতা, ‘‘তুলাই ধানের বীজের সাথে ‘শম্পা’, ‘সাদা এলাই’-এর মতো বিভিন্ন ধানের বীজ মিশিয়ে অনেকে চাষ করেন। তা ছাড়া, বেশি পরিমাণে রাসায়নিক সারের ব্যবহারের কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তুলাই ধান।’’
পরিস্থিতির জন্য কৃষি দফতরের দিকে আঙুল তুলেছেন তুলাই-চাষি প্রফুল্ল দাস। তিনি বলেন, ‘‘জেলার কৃষি আধিকারিকদের উচিত চাষিদের সাথে মাঝেমধ্যেই যোগাযোগ রাখা। চাষবাসের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা ও তার প্রতিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া। বিভিন্ন ধানের বীজের সম্পর্কে জানানো জরুরি। যে ভাবে নকল তুলাইয়ের রমরমা চলছে তাতে জেলার এই ঐতিহ্যকে বেশিদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।’’ প্রায় একই সুরে চাল ব্যবসায়ী দীপঙ্কর সাহার বক্তব্য, ‘‘তুলাইয়ের মান বজায় রাখতে সরকারের আরও বেশি সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন।’’
ভোজনরসিক চিত্রশিল্পী শুভব্রত শিকদার এর মতে, ‘‘এখন তুলাই পাঞ্জি চালের স্বাদ-গন্ধ কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু আমরা পাচ্ছি না, সে আক্ষেপ তো রয়েইছে। পরের প্রজন্মও এই স্বাদ ও গন্ধ থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ছে ভেবে খারাপ লাগে।’’
ইতিহাসের পাতায়
তুলাই চালের নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন তত্তকথা ও মতামত রয়েছে। যদিও অবিভক্ত দিনাজপুরে তুলাই নদীর দুই ধারের উচু ভাঙ্গা জমি গুলিতে তুলাই পাজা ধানের চাষ ব্যাপক পরিমাণে হবার কারণেই তুলাই চাল নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। বর্তমানে এই নদীর জল শুকিয়ে নদীর নাব্যতা হারিয়ে গিয়েছে। অভিধানে তুলাই নামক কোন শব্দ পাওয়া যায়নি। তবে তুলাই অথবা তুলাসালি নামে একটি ধানশস্যের পরিচয় পাওয়া যায়। যা অতি কোমল ও সুগন্ধি তুলার মত নরম। এই তুলন বা তুলাসালি ধানশস্যই তুলাই পাজি নামে পরিচিত। আমাদের ভাষার ধবনিতত্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শব্দটি অপভ্রংশ হয়ে তুলন থেকে তুলনই থেকে তুলাই হয়েছে। আর পাজা শব্দের অর্থ আটি যা বর্তমানে অপভ্রংশ হয়ে পাঞ্জা অথবা পাঞ্জি নামে পরিচিত হয়েছে।
শ্রাবণ মাসের ১৫ তারিখ থেকে ভাদ্রে মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে গচুবনা পুজোর মাধ্যমে তুলাই ধানের রোয়া বোনা সম্পন্ন হয়। প্রকৃতির ঋতু বৈচিত্রের মতোই ধানের ভুবনে তুলাই পাঞ্জি বর্ণময় ও বৈচিত্রময়। ১১০০ খ্রীষ্টপুর্বাদে পণ্ডিত রামাই লিখিত শুন্যপুরান ও সন্ধ্যাকর নন্দী লিখিত রামচরিতেও তুলাইয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। ধানশস্য সম্পর্কে দিনাজপুর জেলার মানুষের যে সব ধারণা, বিশ্বাস, সংস্কার, সতর্কতা, নিষেধ রয়েছে সেই সময় লোকশ্রুতি এবং প্রবাদে তার নিদর্শন পাওয়া যায়। যেমন—
• ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি পরে/ তুল পুঞ্জ আহার আপনি করে়
• তুলধান তুলধান/ যেই জানে সেই মান
• মাছ খামু চিতল ভাকুর/ গচি ফেলামু তুলাই ঠাকুর।
এ ছাড়া বেশ কিছু লোক সঙ্গীতেও তুলাইয়ের বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy