Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Akhil Giri Comment

নিজে ক্ষমা চাইলেন, কিন্তু সরালেন না মন্ত্রী অখিলকে, দিদি হাঁটলেন পুরনো দাদাদের পুরনো পথেই

বিরোধীরা চাইছেন, দ্রৌপদী মুর্মূ সম্পর্কে মন্তব্যের দায়ে অখিল গিরিকে মন্ত্রিসভা থেকে সরানো হোক। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমা চাইলেও সে পথে হাঁটেনি। তবে এমন নজির নতুন নয় রাজ্যে।

দূরত্ব বাড়লেও মন্ত্রিসভায় রইলেন অখিল।

দূরত্ব বাড়লেও মন্ত্রিসভায় রইলেন অখিল। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২২ ১৯:০০
Share: Save:

দল আগেই ‘দূরত্ব’ তৈরি করেছিল। তা আরও স্পষ্ট করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘অখিল-অস্বস্তি’ যে তৃণমূলকে বিড়ম্বনায় ফেলেছে, তা বুঝিয়ে সোমবার মমতা প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘‘অখিল অন্যায় করেছে। আমি দুঃখিত এবং ক্ষমা চাইছি দলের তরফে।’’

নিজে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু অখিলকে মন্ত্রিসভা থেকে সরানো বা তেমন কোনও ‘দৃষ্টান্তযোগ্য’ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলেন না মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা। প্রসঙ্গত, অখিলের হয়ে ক্ষমা চাওয়ার সময় মমতা তাঁর নামোচ্চারণ করেননি। এমনকি, অখিলকে ‘মন্ত্রী’ নয়, দলের ‘বিধায়ক’ বলে উল্লেখ করেছেন। যা থেকে তৃণমূলের একাংশ মনে করছেন, দলের নেতা এবং মন্ত্রীকে কার্যত ‘আড়াল’ই করেছেন দলের সর্বময় নেত্রী। যা বুঝিয়ে দিয়েছে, তিনি অখিলের বিরুদ্ধে কোনও ‘কড়া ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা ভাবছেন না।

রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মূ সম্পর্কে ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য করায় রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল বিজেপি প্রথম থেকেই অখিলকে মন্ত্রিসভা থেকে সরানোর দাবি তুলেছিল। মমতা ক্ষমা চাওয়ার পরেও তারা সেই দাবি থেকে সরছে না। তাদের বক্তব্য, ‘‘ক্ষমা চাইলেই সব মিটে যায় না! অখিলকে মন্ত্রিসভা থেকে সরানো উচিত।’’ সেই দাবিতে রাজ্যপালের কাছে আর্জিও জানিয়েছে বিজেপির পরিষদীয় দল। অখিলকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। মঙ্গলবারেও সুকান্ত আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেছেন, ‘‘আমরা শুধু পদত্যাগ নয়, চাই কারাগার মন্ত্রী কারাগারেই থাকুন! রাষ্ট্রপতিকে যে ভাষায় অপমান করা হয়েছে, তাতে ক্ষমা চাইলেই সব হয়ে যায় না। ক্ষমা চাইলেই হবে না। মুখ্যমন্ত্রীকে সবচেয়ে আগে রামনগরের বিধায়ককে মন্ত্রিসভা থেকে তাড়াতে হবে।’’

কিন্তু মমতা তেমন কিছু করেননি। বরং তাঁর ঘনিষ্ঠরা মনে করছেন, অখিলের কৃতকর্মের জন্য সর্বসমক্ষে ক্ষমা চেয়ে মমতা বিরোধীদের আক্রমণের ঝাঁজ অনেকটাই ‘প্রশমিত’ করে দিতে পেরেছেন। তাঁদের আশা, এর পরে বিষয়টি আর বেশি দূর গড়াবে না। ফলে অখিল যথারীতি কারা দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী হিসাবে থেকে যাবেন।

তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগতর রায়ের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘আমাদের সর্বোচ্চ নেত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমা চেয়েছেন। এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে! ওই মন্তব্য দল যে সমর্থন করে না, তা আগেই জানানো হয়েছিল। এর পরেও মুখ্যমন্ত্রী অন্যায় হয়েছে বলেছেন। এর পরেও বিজেপি কোনও দাবি করলে সেটা ওদের রুচির বিষয়। রাজনীতি করতে চাইছে বলেই ওরা এ সব করে যাচ্ছে।’’

অনেকে মমতার এই মনোভাবে অতীতে সিপিএম সরকারের মনোভাব দেখছেন। সাড়ে তিন দশকের বাম সরকারের আমলে ‘প্রভাবশালী’ মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী থেকে সুশান্ত ঘোষ, কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় থেকে আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ এবং তাঁদের অনেক মন্তব্য নিয়ে শোরগোল হয়েছে। মন্ত্রীদের পদত্যাগের দাবিও উঠেছে। কিন্তু সে পথে হাঁটেননি জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অনিল বিশ্বাসেরা।

যেমন আশির দশকে ‘হোপ এইট্টি সিক্স’-এর আয়োজন করে বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী সুভাষ। তুমুল ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল রাজ্য জুড়ে। ওই অনুষ্ঠানে পুরোপুরি সমর্থন ছিল না সরকারের। তবুও তাঁর মন্ত্রীর পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন বসু। এমনকি, তিনি ওই অনুষ্ঠান দেখতেও গিয়েছিলেন। পরে তারাপীঠ মন্দিরে প্রকাশ্যে পুজো দিয়েও দলের অন্দরে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেতা সুভাষ। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে দিয়েছিলেন, ‘‘আমি আগে হিন্দু, তার পরে ব্রাহ্মণ, তার পরে কমিউনিস্ট।’’ কিন্তু তার পরেও সুভাষের বিরুদ্ধে দল বা সরকারের তরফে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অথবা সুশান্ত ঘোষ। কেশপুর থেকে চমকাইতলা, গড়বেতা থেকে ছোট আঙারিয়া— একের পর এক ঘটনায় পশ্চিম মেদিনীপুরের সেই সময়ের ‘দাপুটে’ নেতা সুশান্তের বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ উঠেছিল। সরাসরি গণহত্যায় যুক্ত থাকার অভিযোগ ছিল। বাম জমানার শেষ দিকে বিরোধীদের উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রেম নয়, ওদের প্যাঁদানি দিন’’ মন্তব্য ঝড় তুলে দিয়েছিল। পরবর্তী কালে বিভিন্ন অভিযোগে তাঁকে জেলে থাকতে হয়েছে। আদালতের নির্দেশে নিজের জেলায় ঢুকতে পারেননি। কিন্তু মন্ত্রী থাকার সময়ে ছিলেন বহাল তবিয়তেই। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দলের অন্দরে সুশান্ত সম্পর্কে তাঁর ‘অপছন্দ’-এর কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু সুশান্তের নাম মন্ত্রিসভা থেকে কাটা যায়নি।

জ্যোতি বসুর জমানাতেই ১৯৮২ সালে দক্ষিণ কলকাতায় বিজন সেতুর উপর ১৭ জন আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীর আগুনে পুড়ে মৃত্যু হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, সিপিএমের নেতা-কর্মীরা ওই ঘটনার সঙ্গে সক্রিয় ভাবে জড়িত ছিলেন। নেতৃত্বে ছিলেন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে দল থেকে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরে কান্তি মন্ত্রীও হয়েছিলেন।

চশমার ‘ভুয়ো’ বিল দেখিয়ে বিধানসভা থেকে টাকা নেওয়ায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব মন্ত্রিসভার সদস্য মানব মুখোপাধ্যায়। বাংলায় বসবাসকারী মাড়োয়ারি সম্প্রদায় সম্পর্কে ‘কুকথা’ বলার অভিযোগ উঠেছিল মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার বিরুদ্ধে। কিন্তু কারও মন্ত্রিত্বে কোনও আঁচ লাগেনি। অখিল-প্রশ্নে অতীতের সেই ‘দাদা’-দের পথেই হাঁটলেন তাঁদের হটিয়ে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করা ‘দিদি’। অর্থাৎ, নিজেদের মন্ত্রীকে ‘বাঁচানোর’ সেই ঐতিহ্য় বামের মতো অ-বাম আমলেও বজায় রইল।

ঘটনাচক্রে, দ্রৌপদী শুধু দেশের রাষ্ট্রপতি নন। তিনি একাধারে প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি এবং আদিবাসী। তৃণমূলের নেতাদের একাংশ বলছেন বটে, অখিলকে বার বার ‘প্ররোচিত’ করায় তিনি অসতর্ক হয়ে রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে ওই মন্তব্য করে ফেলেছেন। কিন্তু সে যুক্তি ধোপে টিকছে না। কারণ, অখিল যাঁর সম্পর্কে ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য করেছেন, তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি। বস্তুত, সে কারণেই অনেকের অভিমত, অখিলকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে মমতা সামগ্রিক ভাবে একটি ‘বার্তা’ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি হাঁটলেন সেই পুরনো রাস্তায়। নিজে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে নিজের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mamata Banerjee Akhil Giri TMC CPM
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE