Advertisement
E-Paper

বেশি বালি? ‘প্যাড’ থাকলেই সব ছাড়

সিউড়ি শহর লাগোয়া রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক ঘেঁষেই জেলাশাসকের বাংলো। গত বছর জুলাইয়ের শেষ দিকে রাত আড়াইটে নাগাদ ওই বাংলো লক্ষ্য করে বোমাবাজি করে দুষ্কৃতীরা।

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২০ ০৭:৫৯
 বেশি বালি নিয়ে ট্রাক্টর যাওয়ার এই ছবি রামপুরহাটে দেখা যায় নিয়মিত। ইনসেটে, এই স্লিপ বা ‘প্যাড’ দেখালেই হয়ে যায় কাজ। নিজস্ব চিত্র

বেশি বালি নিয়ে ট্রাক্টর যাওয়ার এই ছবি রামপুরহাটে দেখা যায় নিয়মিত। ইনসেটে, এই স্লিপ বা ‘প্যাড’ দেখালেই হয়ে যায় কাজ। নিজস্ব চিত্র

এই কারবার বৈধ। কিন্তু বীরভূমের সেই বৈধ বালি কারবারের আড়ালে বেআইনি ভাবে কোটি কোটি টাকার খেলা চলছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আর স্থানীয়দের অভিযোগ, সেই অবৈধ কারবারের দাপট এমনই যে খোদ জেলাশাসকের বাংলোয় বোমাবাজিতে ধৃত বালি কারবারিদের বিরুদ্ধে প্রায় এক বছর পরেও আদালতে চার্জশিট জমা দিতে পারেনি জেলা পুলিশ।

সিউড়ি শহর লাগোয়া রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক ঘেঁষেই জেলাশাসকের বাংলো। গত বছর জুলাইয়ের শেষ দিকে রাত আড়াইটে নাগাদ ওই বাংলো লক্ষ্য করে বোমাবাজি করে দুষ্কৃতীরা। পুলিশ-প্রশাসনের সূত্রেই বলা হয়েছিল, বালি মাফিয়া এর পিছনে থাকতে পারে। কারণ, সে সময় অবৈধ ভাবে বালি মজুত নিয়ে জেলাশাসক কড়া অবস্থান নিয়েছিলেন। লাগাতার প্রশাসনিক অভিযানের ফলে বালি ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। সেই রাগেই হামলা। ওই ঘটনায় যে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়, তারা প্রত্যেকেই ময়ূরাক্ষীর বাঁশজোড় বালিঘাটের সঙ্গে যুক্ত।

তার পরে? সিউড়ি জেলা আদালতের এক প্রবীণ আইনজীবী বলছিলেন, ‘‘এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, এত বড় ঘটনাতেও পুলিশ আজও চার্জশিট দিতে পারেনি।’’ জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘কেন চার্জশিট জমা পড়েনি, সেটা পুলিশই বলবে।’’ জেলা পুলিশ সুপার শ্যাম সিংহ বলেন, ‘‘জেলাশাসকের বাংলোয় বোমাবাজির ঘটনায় আরও কয়েক জন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা বাকি। তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। জেলা পুলিশের একটা দল ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই এখনও চার্জশিট জমা পড়েনি।’’

কী ভাবে চলছে এই বালি কারবার?

অভিযোগ উঠছে, বালি পরিবহণে ব্যবহৃত প্রতিটি গাড়ি থেকে তোলা আদায়ে স্লিপ (স্থানীয় পরিভাষায় ‘প্যাড’)-এর ব্যবহার এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অন্যায় ভাবে লিজ ছাড়াই বিশেষ কাউকে নদীবক্ষ থেকে বালি তোলার অধিকার দেওয়াতেই কারবারের আসল মন্ত্র। খয়রাশোলে অজয় নদ লাগোয়া গ্রামের কিছু বাসিন্দার দাবি, ‘‘রাজনৈতিক দলের নির্দেশে ‘প্যাড’ (আনন্দবাজারের হাতে সেই ‘প্যাড’ আছে) চালু করে পাথর-বালিতে তোলা আদায় চলছে, সেটা সর্বজনবিদিত। প্রশাসন জানে না, এমনও নয়। কিন্তু কিছু হয়নি।’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বৈধ বালি কারবারিদের একাংশও ‘প্যাড’ চালুর সত্যতা মানছেন। এর পাশাপাশি লিজ ছাড়াই খয়রাশোলের ভীমগড় লাগোয়া অজয় নদে বালি তোলার অভিযোগও উঠেছে।

জাতীয় পরিবেশ আদালেতের নির্দেশে নদীবক্ষ থেকে ইচ্ছেমতো বালি তোলায় ২০১৬ সালেই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। বালি তোলার অধিকার অর্জন করতে হলে ই-নিলামে অংশগ্রহণ করতে হয় ইচ্ছুক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে। সর্বোচ্চ দর দেওয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সরকারের তরফে ‘অ্যাওয়ার্ড অব কনট্রাক্ট’ দেওয়া হয়। পরে এক জন লিজপ্রাপ্ত বা লেসি ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে আবেদন করেন। অবেদন গ্রাহ্য হলে যে পরিমাণ বালি তিনি উত্তোলন করবেন, সেই হারে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জমা করে চালান নেন। এখন পুরোটাই অনলাইন হয়েছে। শর্ত পূরণ করে এ যাবৎ বীরভূম জেলার বিভিন্ন নদীর মোট দুই শতাধিক বালি ব্লকের লিজ পেয়েছেন শতাধিক বালি কারবারি।

খেলাটা এর পর থেকেই শুরু হয় বলে অভিযোগ। লিজ নিলেও প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করে কোথাও যন্ত্র লাগিয়ে বালি উত্তোলন, কোথাও বেআইনি বালি মজুত তো আছেই, সব চেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হল, লরি-ট্রাক্টর-ডাম্পারে মাত্রাতিরিক্ত বালি বহন। এই সব কাজ মসৃণ ভাবে চালানোর জন্য সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দেওয়া-সহ নানা অভিযোগ বৈধ বালি-কারবারিদের বিরুদ্ধেও উঠেছে। বালিঘাটের দখল নিয়ে রক্তও ঝরেছে অনেক।

জানা গিয়েছে, অবৈধ কারবারের মুশকিল আসান হিসেবেই চালু হয়েছে ওই ‘প্যাড’। প্রতি গাড়িতে বৈধ কাগজপত্র না থাকুক, শুধু ‘প্যাড’ থাকলেই যথেষ্ট। অতিরিক্ত বালি বোঝাই গাড়িও যাতায়াতের ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে ‘প্যাডের’ দৌলতে। এ ভাবেই টাকার খেলা চলছে বলে অভিযোগ।

কিছু বালি কারবারি জানাচ্ছেন, বালি বহনে প্রতি ১০০ ঘনফুটে প্রায় ২০০ টাকা রাজস্ব দিতে হয়। একটি ১০-১২ চাকার ট্রাক বা ডাম্পারে ৫০০-৫৫০ ঘনফুট বালি নিয়ে যাওয়ার অনুমতি থাকে। তার বেশি হলেই বেআইনি। কিন্তু, বালি তুলে কোনও গ্রাম থেকে বের হতেই উন্নয়নের নামে মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। রাস্তায় উঠলে পুলিশের জুলুম আছে। ফলে বালি কারবারিদের দাবি, এত খাঁই মেটাতে অতিরিক্ত ভারবহন করতে হয়। সেই অতিরিক্ত ভারবহনের ছাড়পত্র পেতে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে ‘প্যাড’ কিনতে হয় সকলকেই। ‘প্যাডের’ জোরে এক-একটি ট্রাক-ডাম্পারে হাজার ঘনফুট বালিও দিব্যি বহন করা যাচ্ছে!

জেলাশাসক যদিও বলছেন, ‘‘প্যাড চালুর বিষয়টি জানা নেই। সত্যিই প্যাড চালু রয়েছে কি না, পুলিশ বলতে পারবে।’’ অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভুমি সংস্কার)শুভ্রজ্যোতি ঘোষের বক্তব্য, ‘‘বালি বহনের জন্য চালান দেওয়া হয়। তার বাইরে অন্য কিছুই বৈধ নয়। প্যাডের কথা শুনিনি।’’ জেলা তৃণমূলের সহ-সভাপতি তথা জেলা পরিষদের মেন্টর অভিজিৎ সিংহের দাবি, ‘‘পুরোটাই ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের বিষয়। ই-টেন্ডারের মাধ্যমে বালি উত্তোলনের অধিকার পান লেসিরা। কোনও প্যাডের কথা আমার কানে আসেনি।’’

তা হলে ‘প্যাড’ এল কোথা থেকে? আর সেই ‘প্যাডে’ টাকাই বা তুলছে কারা? স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের বক্তব্য, বালিতে মুখ গুঁজে থাকলে তো আর ‘প্যাড-চক্র’ থমকে থাকে না!

Sand Tractor Siuri
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy