বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপরে শাসকের নজরদারি নতুন নয়। কিন্তু শনিবার সেই নজরদারির মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন উঠল মেদিনীপুরে। তৃণমূল জমানায় রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে পুলিশ কার্যত গুপ্তচরের ভূমিকা পালন করছে, এমনই অভিযোগে সরব হলেন বিরোধীরা।
বিরোধীদের দাবি, সবং-কাণ্ড প্রসঙ্গে কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ার এ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে ‘পুলিশের চিত্রগ্রাহকের’ উপস্থিতি এবং গোটা পর্বটি ভিডিও-রেকর্ড করে রাখা কার্যত এক ‘বেনজির’ ঘটনা, যা একই সঙ্গে শাসক দলের এবং পুলিশের ‘অবস্থান’কে তির্যক দৃষ্টিতে দেখতে বাধ্য করছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিজে স্বৈরাচারের প্রতিমূর্তি। আর ভারতী ঘোষ তাঁর পোষ্য-কন্যা। ফলে, পুলিশের এই আচরণই তো স্বাভাবিক।’’
পুলিশ সুপারের অবশ্য দাবি, “যত দূর জানি, ওখানে কোনও পুলিশের লোক ছিলেন না। উনি (মানসবাবু) অভিযোগ করলে তদন্ত করে দেখা হবে।’’ ঘটনাটি রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডিকে জানিয়েছেন মানসবাবু। পক্ষান্তরে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘এ রকম ঘটনার কথা শুনিনি। খবর নেব।’’
সবং-কাণ্ডে জেলবন্দি ছাত্র পরিষদের (সিপি) কর্মীদের সঙ্গে দেখা করতে এ দিন মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে যান মানসবাবু। পরে দুপুরে জেলা কংগ্রেস কার্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন তিনি। সেখানেই হাজির ছিলেন চিত্রগ্রাহক সুজয় মাইতি। মেদিনীপুরের এই যুবককে শহরের অনেকে ‘পুলিশের চিত্রগ্রাহক’ হিসেবে চেনেন।
সাংবাদিক সম্মেলনের মাঝে জেলা কংগ্রেস সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়া, জেলা নেতা অরূপ মুখোপাধ্যায় মানসবাবুকে সুজয়ের উপস্থিতির কথা জানান। মানসবাবু তৎক্ষণাৎ জানতে চান, “পুলিশের হয়ে গোয়েন্দাগিরি করছেন? জানেন এটা কত বড় অপরাধ?” ওই যুবক প্রথমে জানান, তিনি ফ্রিল্যান্স চিত্র-সাংবাদিক। মানসবাবু পরিচয়পত্র দেখতে চান। কিন্তু তিনি তা দেখাতে পারেননি। তখন তিনি দাবি করেন, কোতোয়ালি থানা থেকে তাঁকে পাঠানো হয়েছে। পরে ওই চিত্রগ্রাহক চলে যান। কোতোয়ালি থানা অবশ্য দাবি করেছে, তারা ওই সভায় কাউকে পাঠায়নি। সুজয়বাবু তাদের হয়ে ছবি তোলার কাজ করেন কি না, জানতে চাওয়া হলে মুখে কুলুপ আঁটেন থানার অফিসারেরা।
রাজনৈতিক গুপ্তচরবৃত্তি বা তা নিয়ে বিতর্ক—কোনওটাই নতুন নয়। রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ১৯৯১ সালে চন্দ্রশেখর যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন রাজীব গাঁধীর বাড়ির সামনে গুপ্তচর হিসেবে ঘোরাঘুরি করছিলেন সন্দেহে হরিয়ানার দুই কনস্টেবলকে গ্রেফতার করা হয়। তার পরেই সমাজবাদী জনতা পার্টি (রাষ্ট্রীয়) নেতৃত্বাধীন সরকারের পিছন থেকে সমর্থন তুলে নেয় কংগ্রেস। পড়ে যায় চন্দ্রশেখরের সরকার। গত মার্চে আবার নয়াদিল্লিতে রাজীব-তনয় রাহুল গাঁধীর বাড়িতে গিয়ে পুলিশ জানতে চায়, বাবা-মায়ের নাম, বয়স, গায়ের রঙের মতো নানা তথ্য। তখন কংগ্রেসের অভিযোগ ছিল, নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার রাহুলের উপরে ‘রাজনৈতিক গোয়েন্দাগিরি’ চালাচ্ছে। যদিও দিল্লি পুলিশের দাবি ছিল, নিরাপত্তার স্বার্থেই এই পদক্ষেপ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সুভাষচন্দ্র বসুর পরিজনদের উপরে রাষ্ট্রীয় নজরদারির বিষয়টিও সম্প্রতি সামনে এসেছে। তা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি।
রাজ্যেও বিরোধীদের কার্যকলাপে শাসকের নজর রয়েছে বরাবর। কাজটা করে রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (আইবি)। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের ভার রয়েছে আইবি-র এক-একটি দলের উপরে। গোয়েন্দারা বিভিন্ন দল, বিশেষ করে বিরোধীদের কর্মসূচিতে সাদা পোশাকে হাজির থাকেন। অনেক সময় সাংবাদিক বৈঠকেও থাকেন। নানা জিনিস লিখে নেন। অনেক সময় সংবাদমাধ্যমের থেকে ‘ভিডিও ফুটেজ’ও সংগ্রহ করেন। কিন্তু এ দিনের ঘটনা ‘নজিরবিহীন’ বলেই মেনেছেন রাজ্যের এক পুলিশ-কর্তা। মানসবাবুর কথায়, ‘‘বিধানসভাতেও আইবি-র লোক থাকে। কিন্তু পার্টি অফিসে ঢুকে পুলিশের এমন সক্রিয় নজরদারি ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে দেখিনি। এটা মমতা-জমানার অবদান।’’
মানসবাবুর দাবি, ঘটনার পরেই এসএমএসে তিনি পুলিশ সুপারকে বিশদে জানান। জবাবি এসএমএস আসে, ‘আপনি সকলের সামনে মতামত জানাচ্ছিলেন। সেখানে কে আসবে, কে নয়, তা নির্দিষ্টও করে দেননি। অভিযোগ থাকলে স্থানীয় থানায় জানান। তদন্ত করে দেখব।’
পুলিশের ‘ভূমিকা’ আশ্চর্য করেছে বাকি বিরোধীদেরও। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘কারও কোনও গণতান্ত্রিক অধিকার এ রাজ্যে আর সুরক্ষিত নয়। জরুরি অবস্থার সময় যা হতো, এখনকার ঘটনা তাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে কি না, ভেবে দেখার সময় এসেছে।’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের আবার অভিজ্ঞতা, ‘‘পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় যখনই কোনও ঘটনা ঘটছে, আক্রান্তদের পাশে বিরোধীরা দাঁড়াতে গেলে পুলিশ সেখানে ভিডিও রেকর্ডিং করছে। অনেক সময় উর্দিতেই করছে। এ দিন পুলিশ যা করল, সেটা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় হতে পারে, সেটাই অকল্পনীয়।’’
তবে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশের বক্তব্য, পশ্চিম মেদিনীপুর মাওবাদী-প্রভাবিত জেলা। তাই সেখানে পুলিশি তৎপরতা বেশি। দলের প্রথম সারির এক নেতার মতে, ‘‘হুগলি, হাওড়া, দুই ২৪ পরগনায় মন্ত্রী, ভিআইপিদের পুলিশ একটাই ‘পাইলট কার’ দেয়। কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুরে কড়া নিরাপত্তার জন্য সামনে-পিছনে ‘পাইলট কার’ থাকে।’’ কিন্তু সে জন্য কি কংগ্রেসের মতো বিরোধী দলের জেলা কার্যালয়ে নজরদারি চালানোর প্রয়োজন পড়ে? তৃণমূলের ওই শীর্ষ নেতা এ বার চুপ।
সবং মামলায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) অভিযুক্তদের বাঁচাতে পুলিশ সুপার গোড়া থেকেই সক্রিয় বলে অভিযোগ কংগ্রেসের। প্রথমে টিএমসিপি-র তিন জন গ্রেফতার হলেও পরে সিপি-র চার জনকে ধরে পুলিশ। চার্জশিটেও সিপি-র ছেলেদেরই অভিযুক্ত দেখানো হয়েছে। জেলবন্দি সিপি কর্মীদের মধ্যে অনুপম আদক ইতিমধ্যে আদালতে লিখিত ভাবে জানিয়েছেন, পুলিশ তাঁকে ভয় দেখিয়ে গোপন জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে। ওই জবানবন্দি বাতিলের আর্জি জানিয়েছেন অনুপম। এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে মানসবাবুর অভিযোগ, “জেলে গিয়েও পুলিশ অনুপমকে চাপ দিচ্ছে যাতে জবানবন্দি বদল না করে। এ দিনও পুলিশ গিয়েছিল।’’ সবং-কাণ্ডের প্রতিবাদে ৬ অক্টোবর মেদিনীপুরে সভা করার কথা কংগ্রেসের।
পুলিশ সুপার অবশ্য বলেন, “পুলিশ জেলে ঢোকেনি। ঢুকেছিলেন এক রাজনীতিবিদ। মামলা হাইকোর্টের বিচারাধীন থাকা অবস্থায় উনি জেলে গিয়ে মামলার মুখ্য সাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমি এটুকু শুনেছি।”