Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

ধাওয়া করে ডাকাত তাড়ালেন বৃদ্ধা

বৃদ্ধার তাড়া খেয়ে মঙ্গলবার দুপুরে পালিয়েছে ডাকাতেরা। কিন্তু দিনের পর দিন চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনায় উদ্বিগ্ন বসিরহাট মহকুমার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। পরিস্থিতি কেমন, নজর রাখল আনন্দবাজার।দিনের পর দিন দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত মানুষজন। চুরি-ছিনতাইয়ের রমরমা কিংবা মদ-গাঁজা-হেরোইনের ঠেকে দুষ্কৃতীদের হইহল্লা শুনে শুনে হতাশ তাঁরা। এরই মধ্যে ব্যতিক্রমী মুহূর্তের জন্ম দিলেন কাকলি মণ্ডল।

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০১:২৭
Share: Save:

দিনের পর দিন দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত মানুষজন। চুরি-ছিনতাইয়ের রমরমা কিংবা মদ-গাঁজা-হেরোইনের ঠেকে দুষ্কৃতীদের হইহল্লা শুনে শুনে হতাশ তাঁরা। এরই মধ্যে ব্যতিক্রমী মুহূর্তের জন্ম দিলেন কাকলি মণ্ডল।

বয়স ষাট। ছেলে-বৌমা-নাতনি নিয়ে সংসার। সাধারণ আটপৌরে পরিবার। সেই মহিলাই রুখে দিয়েছেন ডাকাতদের। মঙ্গলবার এমনই ঘটনার সাক্ষী থাকল বসিরহাট পুরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের মির্জাপুরে।

কাকলিদেবীকে গলায় ভোজালি ধরে সোনার গয়না খুলে দিতে বলেছিল ডাকাতেরা। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, বেলা সাড়ে ৩টে নাগাদ দু’টি ঘরের একটিতে শুয়ে ছিলেন কাকলিদেবী। অন্য ঘরে ছিল পরিবারের বাকিরা। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ পেয়ে আধো ঘুমের মধ্যে উঠে বসেন কাকলিদেবী। সামনে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে দুই অপরিচিত মুখ। কী যেন খুঁজছে এ দিক ও দিক। কাকলিদেবীকে উঠে বসতে দেখে একজন চোখ পাকিয়ে এগিয়ে আসে। গলায় ভোজালি ধরে। অন্য হাতে রিভলবার। সোনার গয়না চায় তারা।

কাকলিদেবী দেননি। ভয় পাননি। উল্টে ‘ডাকাত ডাকাত’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। দুই দুষ্কৃতী এগোনোর সাহস পায়নি। তারা ঢুকে পড়ে পাশের ঘরে। কাকলিদেবীর বৌমা রুমা মণ্ডল বলেন, ‘‘বোন এসেছে। মেয়েকে নিয়ে আমরা এক খাটেই শুয়েছিলাম। শাশুড়ি মায়ের চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ি। ওরা আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে, গলায় ভোজালি ধরে গয়না চায়।’’ কিন্তু ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন রুমা। এরপরে আর দুঃসাহস দেখায়নি দুষ্কৃতীরা। দৌ়ড় দেয়। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের আরও এক সাগদের। সে-ও সঙ্গীদের মতিগতি দেখে পিঠটান দেয়। আঁচল কোমরে গুঁজে চেঁচাতে চেঁচাতে পিছু নেন কাকলিদেবী। একটু তফাতে তাঁর বৌমা।

মিলি দত্ত নামে একজনের কথায়, ‘‘সরস্বতী পুজোর মাইক বাজছিল। ওঁদের চিৎকার তেমন শোনা যায়নি। হঠাৎ দেখি, মাসিমা (কাকলিদেবী) দৌড়োচ্ছেন। সামনে পড়িমড়ি করে ছুটছে তিন যুবক। তখনই বিষয়টি পরিষ্কার হয়। লোক জড়ো হয়ে যায়।’’

তবে তারাও দৌড়াদৌড়ি করে কারও নাগাল পায়নি। পুলিশ এলে পাশের আলাঘরে তল্লাশি চালানো হয়। কিন্তু ধরা যায়নি কাউকে।

এ দিনই বসিরহাট থানার আইসি বদল হয়েছে। গৌতম মিত্রের জায়গায় এসেছেন তপন মিশ্র। ফলে এ দিনই দুষ্কৃতী হামল ঘটায় বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে পুলিশ। তবে এলাকার মানুষের অভিযোগ, এমন ঘটনা নাকি আগেও ঘটেছে। স্থানীয় কাউন্সিলর অদিতি মিত্র রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘এলাকায় চুরি-ছিনতাই এবং দুষ্কৃতী উপদ্রব বাড়ছে। বিশেষ করে এ দিন যে ভাবে ব্যাঙ্ককর্মী দেবব্রত মণ্ডলের বাড়িতে দিনের বেলায় হামলা চালাল দুষ্কৃতীরা, তাতে আতঙ্ক বেড়েছে। আমাদের নিরাপত্তা কোথায়?’’ তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশকে আগেও বলেছি, এ বারও বলছি, আপনারা আর একটু তৎপরতার সঙ্গে দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার না করলে মানুষ আতঙ্কের মধ্যে কাটাচ্ছে। ভয়ে বাড়ি খালি রেখে কোথাও যেতে পারছে না।’’

মিলি দত্ত, কমলা গোলদাররা বলেন, ‘‘সম্প্রতি আমাদের বাড়ির সর্বস্য লুঠ করে নিয়ে গেছে দুষ্কৃতীরা। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। পুলিশ নির্বিকার।’’ রুনু শিপ্রা মিত্র, পূর্ণিমা মিত্র, বাদল মিত্র, চন্দনা মজুমদার, তনু মিত্র, রেখা গোলদাররা বলেন, ‘‘এলাকায় দুষ্কৃতীরা মদ, গাঁজা এবং হেরোইনের ঠেক বসাচ্ছে। বহিরাগতরা ওই ঠেকে আসছে। সামনেই টাকি রোডে সিনেমা হলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বহিরাগতদের টোন-টিটকারির ঠেলায় সন্ধ্যার পরে মহিলারা বাইরে বেরোতে সাহস পাচ্ছেন না। এমনকী, পুকুরে স্নান করতে গেলেও বহিরাগতদের কটূক্তির মুখে পড়তে হয়। পুলিশকে জানিয়েও কোন কাজ হয় না।’’

বস্তুত, বসিরহাটের নানা প্রান্তেই চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেই চলেছে। সম্প্রতি স্বরূপনগরে ক্লোরোফর্ম ছিটিয়ে গৃহস্থকে ঘুম পাড়িয়ে একের পর এক লুঠপাটের ঘটনার কোনও কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। তা নিয়ে ক্ষোভ আছে বিস্তর। মহকুমা অন্য প্রান্তেও ছোটখাট চুরি-ছিনতাই, ব্যবসারী টাকা লুঠ চলছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত কয়েক দিনে বসিরহাটের দণ্ডিরহাট, শিবহাটি, ইটিন্ডা-সহ বিভিন্ন এলাকায় দোকান ভেঙে কিংবা মোটর বাইক আটকে লুঠপাট চালায় দুষ্কৃতীরা বলে অভিয়োগ। গৃহস্থের বাড়িতেও চুরির ঘটনা ঘটছে।

সম্প্রতি রাত ৮টা নাগাদ ঘোজাডাঙার দিক থেকে মোটর বাইকে বাড়ি ফিরছিলেন ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ী মফিজুল মণ্ডল। অভিযোগ, ওল্ড সাথক্ষিরা রাস্তার আখাড়পুরের তেঁতুলতলার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে দুষ্কৃতীরা গাড়ি আটকায়। তাঁর সঙ্গে থাকা বেশ কয়েক হাজার টাকা, জরুরি নথিপত্র নিয়ে পালায়। গত কয়েক দিনে সংগ্রামপুরের আলসিখানা এবং ঢেমঢেমি মোড় এলাকায় সীমান্ত বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত দুই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দুষ্কৃতীরা কয়েক লক্ষ টাকা লুঠ করেছে বলেও অভিযোগ। ইটিন্ডায় চুরির ঘটনা ঘটছে প্রায় নিয়মিত।

শিবহাটি হাসপাতালের পাশে থাকেন শুভ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘এলাকায় প্রায়ই চুরি হচ্ছে। গত রবিবার রাতে আমাদের বাড়ি থেকে দুষ্কৃতীরা গ্যাস সিলিন্ডার এবং নগদ কয়েক হাজার টাকা-সহ মালপত্র নিয়ে পালায়।’’ ওই এলাকার অমল সর্দারের বাড়ি থেকে স্যালো মেশিন নিয়ে যায়। মায়া বিশ্বাস, ঝন্টু দে, গোবিন্দ সর্দার, জয়দেব অধিকারীর বাড়িতেও দুষ্কৃতীরা হামলা চালিয়ে সাইকেল, গ্যাস সিলিন্ডার, বাসনপত্র, জামাকাপড় নিয়ে পালিয়েছে।

বাদুড়িয়া, স্বরূপনগর, হাড়োয়া, হিঙ্গলগঞ্জ, মিনাখাঁ, সন্দেশখালি, হাসনাবাদেও একই পরিস্থিতি। বাদুড়িয়ায় আঁধারমানিক গ্রামের বাসিন্দা হিরণ বিশ্বাসের বাড়ির উঠোনে মোটর বাইক রাখা ছিল। একজন সেটি চুরি করে পালায়। গাড়ির মালিক মারফত খবর পেয়ে পুলিশ দুষ্কৃতীর পিছু ধাওয়া করে। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে বড় রাস্তা ছেড়ে সে একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ে। ওই রাস্তার পাশে একটা মোটর বাইক রাখা ছিল। চুরির মোটর বাইক সেখানে রেখে চোর ওই মোটর বাইক নিয়ে পুলিশের সামনে দিয়েই পালায়। গাড়ির নম্বরের সঙ্গে না মেলায় পুলিশও প্রথমটায় কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। বাদুড়িয়ার মন্দিরপাড়ার বাসিন্দা এক মহিলার কানের দুল টেনে নিয়ে পালায় এক দুষ্কৃতী। ঢালিপাড়াতেও চুরির ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি।

হাসনাবাদের খড়মপুর ও রামানন্দপুর গ্রামে কখনও তালা ভেঙে, দরজা-জানলা ভেঙে দুষ্কৃতীরা ঘরে ঢুকে যথেচ্ছ লুঠপাট চালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন এমন ঘটনায় আতঙ্কিত দুই গ্রাম। ঘুমের ওষুধ স্প্রে করা হচ্ছে বলে অনুমান। বাসিন্দারা জানান, গত পনেরো দিনে ওই দু’টি গ্রামের প্রায় ১২টি বাড়িতে একই ভাবে হামলা চালিয়ে কয়েক লক্ষ টাকার মালপত্র, টাকা, গয়না নিয়ে পালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। বাড়িতে লোক থাকা সত্ত্বেও যে ভাবে দরজা-জানলা ভাঙছে দুষ্কৃতীরা, তাতে আতঙ্ক আরও বেশি ছড়িয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

state news burglery gang old woman caught bugler
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE