Advertisement
E-Paper

স্রোত হারিয়েছে আগেই, এখন সঙ্কট অস্তিত্বের

অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে...। রবি ঠাকুরের সেই অঞ্জনা আজ বিস্মৃতির মুখে। কথিত, কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় চূর্ণী আর জলঙ্গির মাঝে জলপথ হিসেবে নদীটি তৈরি করান। ১৭৭৬ সালে রেনেল সাহেবের ‘সিস্টেমেটিক সার্ভে’-তে অঞ্জনার অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। কিন্তু বর্তমানে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে অঞ্জনার বেশির ভাগ অংশই দখলদারদের কব্জায় চলে গিয়েছে।

অশোক সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৫ ০৩:৫৪
শহরের মধ্যে এই হাল অঞ্জনা ‘খাল’-এর। নদী বুজে যাচ্ছে আবর্জনা ও কচুরিপানায়। ছবি: প্রতিবেদক।

শহরের মধ্যে এই হাল অঞ্জনা ‘খাল’-এর। নদী বুজে যাচ্ছে আবর্জনা ও কচুরিপানায়। ছবি: প্রতিবেদক।

অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে...। রবি ঠাকুরের সেই অঞ্জনা আজ বিস্মৃতির মুখে।

কথিত, কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় চূর্ণী আর জলঙ্গির মাঝে জলপথ হিসেবে নদীটি তৈরি করান। ১৭৭৬ সালে রেনেল সাহেবের ‘সিস্টেমেটিক সার্ভে’-তে অঞ্জনার অস্তিত্ব অনুমান করা যায়। কিন্তু বর্তমানে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে অঞ্জনার বেশির ভাগ অংশই দখলদারদের কব্জায় চলে গিয়েছে। শহুরে মানুষের অত্যাচারে নদী তার স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়েছে। কোথাও কোথাও তা বিচ্ছিন্ন পুকুর বা দীঘির চেহারা নিয়েছে।

কী ভাবে উৎপত্তি হল অঞ্জনার?

বন্যার সময়ে জলঙ্গির জলস্তর মোহনার কাছে অর্থাৎ নবদ্বীপে ভাগীরথীর জলস্তরের অপেক্ষা নীচে থাকে। এর ফলে জলঙ্গির জল ভাগীরথীতে মিশতে পারে না, পিছনের দিকে ফিরে আসে। তখনই মূল নদী কোন‌ও ঢালু অংশে নতুন করে প্রবাহিত হতে শুরু করে। এই ভাবেই জলঙ্গির শাখা নদী হিসেবে অঞ্জনার উৎপত্তি। কৃষ্ণনগরের কাছে ৫২ নম্বর রুইপুকুর মৌজা থেকে উৎপত্তি হয়ে অঞ্জনা কৃষ্ণনগরের ক্যাথিড্যাল চার্চের সামনে দিয়ে বেজিখালি মোড় হয়ে শক্তিনগর হাসপাতাল অতিক্রম করে দোগাছির কাছে পৌঁছেছে। সেখানকার হাট বোয়ালিয়ার কাছে দু’টি ভাগে ভাগ হয়েছে নদী। এক অংশ জালালখালি, জলকর পাটুলি, বাদকুল্লা, চন্দনপুকুর হয়ে ৩৪ নম্বর ব্যাসপুর মৌজার কাছে চূর্ণী নদীতে মিশেছে। অন্য অংশটি মূলত হেলের খাল নামে পরিচিত। হাট বোয়ালিয়া থেকে যাত্রাপুর, জয়পুর, গোবিন্দপুর, ইটাবেড়িয়া, হয়ে হাঁসখালির কাছে চূর্ণী নদীতে গিয়ে পড়েছে।

অঞ্জনা নদী তার স্বাভাবিক ছন্দ হারাতে শুরু করেছে রাজাদের আমল থেকেই। কৃষ্ণনগরের রাজা রুদ্র রায়ের সময়কাল ছিল ১৬৮৩ থেকে ১৬৯৪ পর্যন্ত। ওই সময়েই বিপত্তির শুরু। নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পিতা দেওয়ান কার্তিক কের্ত্তীকেয়ন চন্দ্র রায় ‘ক্ষিতীশ বংশচরিত’-এ লিখছেন, ‘‘একদা এক যবন সেনাপতি অঞ্জনা নদী দিয়া যাইতেছিল। তাঁহার সমভিব্যাহারী নৌকা সকল রাজার খিড়কীর ঘাটে উপস্থিত হইলে দোবারিগণ তথায় নৌকা লাগাতে নিষেধ করিল। যবনেরা তাহাদিগের কথা শুনিল না। ক্রমশ উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ উপস্থিত হইয়া কতিপয় লোক আহত হইল। এই কারণে রুদ্র পরাবশে নদী বন্ধ করে দিলেন।’’ তখন থেকেই জলঙ্গি থেকে বিচ্ছিন্ন অঞ্জনা।

সেই পরম্পরা আজও সমানতালে চলছে। বেজিখালির মোড় থেকে হরিজন পল্লি পর্যন্ত বেশ কয়েকশো মিটার বিস্তীর্ণ রাস্তার পাশ দিয়ে প্রবাহিত অঞ্জনা। এ অংশে অঞ্জনাকে নদী বলে মালুম হওয়া দায়। এমনকী রাস্তার উপরেই পুরসভার টাঙানো হোর্ডিংয়ে অঞ্জনা নদী বলে উল্লেখ নেই। সেখানে পরিষ্কার লেখা রয়েছে: ‘‘অঞ্জনা খাল ভরাট করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।’’ ওই হুঁশিয়ারিই সার। নদীতে ফেলা হচ্ছে নোংরা-আবর্জনা। নদী দখল করেই গজিয়ে উঠেছে বহুতল। বেজিখালি মোড়ে নদী বুজিয়ে তৈরি করা হয়েছে আঁস্তাকুড়। আশপাশের বিভিন্ন দোকানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক, চায়ের ভাঁড়, অপ্রয়োজনীয় ফ্লেক্স-ব্যানার সবই পড়ছে সেখানে। আবর্জনার স্তূপ পেরিয়েই মিটার তিরিশেক দূরে নদীবক্ষেই তৈরি হয়েছে দোকানপাট। সেখানে নদীর অস্তিস্তই বোঝা মুশকিল। আগাছা, ঘন কচু বন নদীকে ঢেকে দিয়েছে। কচু বন পেরিয়ে নদীর গতিপথকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দিয়ে বানানো হয়েছে পিচঢালা রাস্তা। রাস্তা পেরিয়ে অঞ্জনা পুনরায় আঁকাবাঁকা পথে যাত্রা শুরু করে পৌঁছেছে শক্তিনগর হাসপাতালের কাছে। ২০০৪ সাল নাগাদ জেলা হাসপাতালের গোটা পাঁচেক নিকাশি নালা তৈরি হয়। হাসপাতালের সমস্ত বর্জ্য প্রতিনিয়ত গিয়ে পড়ছে নদীতে। কৃষ্ণনগরের এক অশীতিপর বাসিন্দা রণজিৎ সান্যাল বলেন, “১৯৮২-তে যখন এখানে আসি, তখনও নদীর হাল ভাল ছিল। এখন নদীর এই অবস্থায় মশা-মাছির উপদ্রব বাড়ছে। এলাকা অস্বাস্থ্যকর হচ্ছে।” সিপিএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফের তরফে শহরে বিভিন্ন জায়গায় অঞ্জনা নদীর হাল ফেরাতে সাঁটানো হয়েছে পোস্টার।

নদীর হাল ফেরাতে পুরসভা কী উদ্যোগী হয়েছে?

কৃষ্ণনগরের পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহা বলেন, ‘‘বাম আমল থেকেই শুরু হওয়া অবহেলায় আজ খালের এই হাল। ১৯৯৮-তে আমি ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি উন্নতি করতে সমীক্ষা করি। দেখা যায়, খালের উপর বেআইনি ভাবে বহু বাড়ি তৈরি হয়েছে। খাল-সংলগ্ন বিতর্কিত জমিতে নকশা মঞ্জুর বন্ধ করার নির্দেশ দিই। খালের কিছু সংস্কার গত অর্থবর্ষে করেছি।” কৃষ্ণনগর পেরিয়ে গ্রামেও লোকজন দখল করে নিয়েছে নদীর। খামার সিমুলিয়া, ব্যাসপুর, পাটুলির কাছে অঞ্জনার উপরে আবার চোখ পড়েছে কিছু চাষির। তাঁরা নদী বুজিয়ে দিয়ে জবরদখল করে সেখানে দিব্যি চাষাবাদ করছেন। এ ব্যাপারে কোনও পঞ্চায়েত প্রধান ও প্রশাসনিক আধিকদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। তবে নদীর বেশির ভাগ দখল করেছেন কৃষ্ণনাগরিকদের একাংশ। শহরের মধ্যেই অঞ্জনার উপর ‘উন্নয়নের’ স্বার্থে তৈরি হয়েছে এক ডজন কালভার্ট। নদী বিশেষঞ্জ সুপ্রতিম কর্মকার তাঁর ‘নদিয়ার নদ-নদী ও জলভূমি কথা’ গ্রন্থে লিখছেন, ‘‘২০০০ সালে বন্যার সময় শহরের জল নামানোর ক্ষেত্রে অঞ্জনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। তার পর পুরসভা নদীর বহতাকে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করে। তত দিনে অবশ্য, পুরসভার নথিই বলছে, শহরের মধ্যে নদীর ৮৯ শতাংশ অংশই চলে গেছে লুঠেরাদের হাতে।’’

স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই অবশ্য মাঝেমধ্যে অপরিকল্পিতভাবে জায়গায়-জায়গায় অঞ্জনার সংস্কার শুরু হয়েছিল। ১৯৫১ সালে নদিয়া জেলার তদানীন্তন ম্যাজিস্ট্রেট মণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অঞ্জনার সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তবে সেই চেষ্টা সে ভাবে ফলদায়ক হয়নি। তবে ২০০৬ সালে জেলা পরিষদের উদ্যোগে কৃষ্ণনগরের দক্ষিণে অঞ্জনার সামান্য সংস্কার হয়েছিল। ২০০৮ সালে কৃষ্ণনগর উত্তরের তৎকালীন বিধায়ক সিপিএমের সুবিনয় ঘোষের বিধায়ক এলাকা উন্নয়ন তহবিলের অর্থে সংস্কার শুরু হলেও সে ভাবে অগ্রসর হয়নি। পরে জেলা প্রশাসন একশো দিনের কাজে স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালের ২৩ নভেম্বর অঞ্জনা সহ মৃতপ্রায় নদ-নদী ও খাল-বিলের বহতা ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা হাতে নেয়। স্থির হয়, এই খাতে ৪০ লক্ষ কর্মদিবস কাজে লাগানো হবে এই খাতে। কিন্তু সে কাজ এখনও শেষ হয়নি।

তৃণমূল নিয়ন্ত্রিত জেলা পরিষদের সভাধিপতি বাণীকুমার রায় বলেন, “২০১৩-র সেপ্টেম্বর মাসে আমরা দায়িত্বে এসেছি। খাল সংস্কারের কাজ হচ্ছে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে। কিন্তু সে টাকা আসছে না।” এ নিয়ে সেচ দফতরের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে বলে জানান বাণীবাবু। অঞ্জনার বেহাল দশা নিয়ে সরব হয়েছেন কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়াও। তিনি বলেন, “জেলার বিভিন্ন নদী ও খালের অনেকটাই বুজে যেতে বসেছে। সেচমন্ত্রী থাকাকালীন এগুলির হাল ফেরানোর জন্য ২৫ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করি। মন্ত্রী থাকাকালীন কাজের তদারকিও করেছিলাম। এখন সে সব বন্ধ।’’

দোষারোপ-পাল্টা দোষারোপের মধ্যে অঞ্জনার হাল কি আদৌ ফিরবে?

সহ প্রতিবেদন: মনিরুল শেখ।

rabindranath tagore anjana river ashok sengupta krishnanagar hospital
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy