Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

টক্করে তৃণমূলের দরকার ছিল আরাবুলকেই

বাম আমলে তিনি ছিলেন ভাঙড়ের তৃণমূল বিধায়ক। সিপিএমের মন্ত্রী গৌতম দেবের সঙ্গেও তাঁর ‘সুসম্পর্ক’ ছিল। এতটাই যে বৈদিক ভিলেজ কাণ্ডের পরে তৎকালীন বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিরক্তি প্রকাশ করে দলেরই অন্দরে বলতে শোনা গিয়েছিল, “ওদের মন্ত্রী আমাদের বিধায়ককে এত ঘন ঘন ফোন করে কেন?” নিজেও আরাবুলকে ফোন করে মমতা সাবধান করেছিলেন, “গৌতম দেবের সঙ্গে এত কী কথা!”

শুভাশিস ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৩৫
Share: Save:

বাম আমলে তিনি ছিলেন ভাঙড়ের তৃণমূল বিধায়ক। সিপিএমের মন্ত্রী গৌতম দেবের সঙ্গেও তাঁর ‘সুসম্পর্ক’ ছিল। এতটাই যে বৈদিক ভিলেজ কাণ্ডের পরে তৎকালীন বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিরক্তি প্রকাশ করে দলেরই অন্দরে বলতে শোনা গিয়েছিল, “ওদের মন্ত্রী আমাদের বিধায়ককে এত ঘন ঘন ফোন করে কেন?” নিজেও আরাবুলকে ফোন করে মমতা সাবধান করেছিলেন, “গৌতম দেবের সঙ্গে এত কী কথা!”

পরিবর্তনের সরকারে আরাবুল অবশ্য বিধায়ক হয়ে ফিরতে পারেননি। কিন্তু পদ খুইয়েও দলের কাছে তিনি পেয়েছেন ‘তাজা নেতা’র মর্যাদা! সর্বদাই সাত খুন মাফ হয়েছে তাঁর।

ভাঙড়ের পাশাপাশি রাজারহাটেও এক সময়ে যাতায়াত ছিল আরাবুলের। কেউ কেউ বলেন, গৌতমবাবুর সুবাদেই রাজনীতিতে উঠে এসেছিলেন আরাবুল। পরে এই সংখ্যালঘু নেতাকে দলে টেনে নেয় তৃণমূল। যদিও সিপিএম এবং তৃণমূল নেতৃত্ব সে কথা অস্বীকার করেছেন। তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব জানান, দল প্রতিষ্ঠার গোড়া থেকেই আরাবুল তাঁদের দলে আছেন। সিপিএম নেতৃত্বের বক্তব্য, রাজারহাটে বিভিন্ন প্রকল্প ঘিরে সমস্যা মেটাতে বিধায়ক আরাবুলের সঙ্গে কথা বলতেন তৎকালীন আবাসনমন্ত্রী গৌতমবাবু।

বামেদের সঙ্গে আরাবুলের ওঠাবসার ঘটনা ভাল চোখে দেখতেন না মমতা। কিন্তু তৎকালীন ‘লালদুর্গ’ ভাঙড়ে সিপিএমের সঙ্গে টক্কর দিতে ডাকাবুকো নেতা আরাবুলকেই দরকার ছিল তৃণমূলের।

২০০৬ সালে ভাঙড় বিধানসভা আসনে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হন আরাবুল। দীর্ঘ বাম জমানায় সিপিএমের বিরুদ্ধে জমতে থাকা ক্ষোভ ভোটবাক্সে ভরসা রেখেছিল আরাবুলের উপরে। সেই তাঁর উত্থানের শুরু। পরবর্তী কিছু বছরে জমি দখল, ভেড়ির টাকা আদায়, মারপিট, হুমকি-শাসানি নানা সময়ে আরাবুলের প্রতাপ দেখেছে ভাঙড়। বাম জমানার এক প্রাক্তন মন্ত্রীর কথায়, এলাকার বিধায়ক হিসেবে আরাবুলকে তৎকালীন ভাঙড়-রাজারহাট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-র (্ব্রাডা) সদস্য করেন গৌতমবাবু। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই সিন্ডিকেট-রাজ গড়ে তোলেন দাপুটে এই নেতা। ২০০৬ সালের ৬ ডিসেম্বর লেদার কমপ্লেক্স থানার ওসিকে মারধরের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন আরাবুল। বিধানসভায় তাণ্ডব চালানোর সময়েও সামনের সারিতে ছিলেন তিনি। কাঁটালিয়ায় সিপিএমের মিছিলে হামলার ঘটনার পরে সেখানে সভা করতে গিয়ে প্রাক্তন আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “উনি (আরাবুল) আমার কাছে আসতেন। আমি বলতাম, মারামারি করে কী হবে? প্রকল্প নিয়ে আসুন, টাকা দিচ্ছি। এলাকায় উন্নয়ন করুন। কিন্তু উনি সে সব কথায় কান দিতেন না।” ঘনিষ্ঠ মহলে আরাবুলকে বলতে শোনা যেত, “সিপিএমের সঙ্গে টক্কর তো নিতেই হবে।”

সেই ‘টক্কর’ নিতে গিয়েই নানা সময়ে নানা ঘটনায় অভিযোগের তির তাঁর দিকে। সিপিএম তো বটেই, দলের বিরোধী গোষ্ঠীকেও রেয়াত করেননি আরাবুল। একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে শেষমেশ ২০১১ সালে ভোটে হারেন তিনি। তাতে অবশ্য রাজ্যপাটে টোল খায়নি। বরং তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে তাঁর পোয়াবারো হয়। ভাঙড় কলেজে শিক্ষিকাকে জগ ছোড়ার ঘটনার অভিযোগ ওঠার পরেও দল তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। ২০১২ সালের ২২ এপ্রিল কাশীপুর থানার এক সাবইনস্পেক্টরকে মারধরের ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও মামলাই শুরু করেনি পুলিশ। দলের অন্দরে যিনি আরাবুলের ‘গুরু’ বলে পরিচিত, সেই পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরে ‘শিক্ষিত সমাজের’ প্রতিনিধি হয়ে মন্ত্রীকে ফুলের তোড়া হাতে অভিনন্দন জানাতে নবান্নে গিয়েছিলেন মাধ্যমিক-অনুত্তীর্ণ ভাঙড়ের এই নেতা।

আসলে ভাঙড়ে বামেদের পায়ের তলায় জমি সরাতে আরাবুলের উপরই ভরসা রাখতে হচ্ছিল শাসক দলকে। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা, সিপিএম নেতা সাত্তার মোল্লাদের ঠেকাতে বারবারই আরাবুলকে অস্ত্র করেছে তৃণমূল। খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পরে আদালতের নির্দেশে ইদানীং এলাকায় ঢুকতে পারেন না সাত্তার। রেজ্জাককে মারধর ও খুনের চেষ্টার অভিযোগে হাজতে যান আরাবুল। তখন লকআপের গরাদ ঝাঁকিয়ে তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, “যা করেছি দলের জন্যই করেছি। দলের নির্দেশে করেছি।” ওই ঘটনার পরে ভাঙড়ের সভায় গিয়ে পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র তাঁকে দলের ‘তাজা নেতা’ বলে সার্টিফিকেট দেন।

জামিনে ছাড়া পেয়ে ফের আরাবুলের প্রতাপে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেতে শুরু করে ভাঙড়ে। কিছু দিন আগেই আরাবুল-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত দলের এক কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করায় কাশীপুর থানার গেটে গিয়ে হুজ্জুত বাধান তিনি। খুনের মামলায় অভিযুক্ত আরাবুল ঘনিষ্ঠ ভাঙড় ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গির খান চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেফতার করতে গেলে সভা করে তিনি হুমকি দেন, পুলিশ জাহাঙ্গিরকে গ্রেফতার করতে গেলে তিনি ওই নেতার বাড়ির সামনে বসে থাকবেন। প্রয়োজনে রক্তগঙ্গা বইয়েও আটকাবেন গ্রেফতারি। বলাই বাহুল্য, এমন হুমকির পরে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নড়েচড়ে না-বসায় পুলিশ জাহাঙ্গিরকে ঘাঁটানোর সাহস করেনি।

গত শনিবার ভাঙড়ের বেঁওতায় আরাবুল-বাহিনীর গুলিতে দু’জনকে খুনের অভিযোগ ওঠার পরে রাজ্য রাজনীতিতে শোরগোল পড়লেও আরাবুল ছিলেন নিজের মেজাজেই। ঘটনার পরদিন থানায় বসে চা-বিস্কুট খেতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। এফআইআরে কার নাম থাকবে বা থাকবে না, তা তিনিই ঠিক করে দেন বলে অভিযোগ। যেমন, বেঁওতা ২ পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান পাঁচু মণ্ডলের উপরে হামলার অভিযোগ ওঠে আরাবুলের দলবলের বিরুদ্ধে। সেই পাঁচুকে আরাবুল অনুগামী বাপন মণ্ডলকে খুনের অভিযোগে ধরে পুলিশ। অবশ্য রমেশ ঘোষালের খুনের ঘটনায় সোমবার রাতে আরাবুল-ঘনিষ্ঠ দু’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের নাম কুতুবুদ্দিন গাজি ও আলম সাহাজি। মঙ্গলবার তাদের বারুইপুর আদালতে তোলা হলে বিচারক দু’জনকে ৫ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

নেতারা ফোন ধরেননি, রাগে ছুড়ে ফেললেন মোবাইল

মঙ্গলবার দুপুরেও ভাঙড় ২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে বসে ছিলেন তিনি। অনুগামীদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। বলা যায়, খোশমেজাজেই ছিলেন। ছবিটা বদলাল সন্ধে সাড়ে পাঁচটার পরে। অনুগামীদের কাছে খবর এল, ‘দাদা’কে ছ’বছরের জন্য বহিষ্কার করেছে দল। তখনও ‘দাদা’র কাছে খবরটা পৌঁছয়নি।

একটু পরেই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণাটি করলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় অনুগামীদের ছোটাছুটি। কেউ বসে পড়ছেন টিভির সামনে, কেউ আবার অল্পেতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন। তাঁদের এক কথা, ‘‘দাদা এত কিছু করল, তাকেই কিনা ছ’বছরের জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হল?’’

খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই পাড়ায় পাড়ায় প্রায় অকাল বন্ধ শুরু হয়ে যায়। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। খবর পৌঁছয় আরাবুলের কানেও। বিচলিত হয়ে পড়েন তিনি। খবরটা শোনার কিছু ক্ষণের মধ্যেই একটি সাদা গাড়ি চড়ে পোলেরহাটে দলীয় অফিসে চলে যান। সঙ্গে যান ছেলে হাকিমুলও।

অনুগামীরা এ বার ভিড় জমান দলীয় অফিসের সামনে। সকলে ‘দাদা’র দিকে তাকিয়ে। বিচলিত আরাবুল চেয়ারে বসে। এক অনুগামীর কথায়, “দাদা, এক-এক জন বড় নেতাকে ফোন করছিলেন। কেউ ফোন ধরেননি।” রেগে টেবিলের উপর মোবাইল ছুড়ে ফেলেন আরাবুল। তাঁর মেজাজ দেখে কথা বলারও সাহস হয়নি কারও। তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন আরাবুল কী পদক্ষেপ করবেন তা জানতে। দলীয় অফিস থেকে সন্ধে সওয়া ৬টা নাগাদ বেরিয়ে যান আরাবুল। এর পরেই তাঁর দু’টি মোবাইল ‘বন্ধ’ হয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bhangor arabul islam subhasish ghatak tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE