E-Paper

রবীন্দ্রগানে নতুন তারার বিচ্ছুরণ

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে ভারতীয় মার্গগানের সম্পর্কের নানা বিশেষত্বের মধ্যে একটি ধ্রুপদকে তার ভাবার্থে সমাদর করা। শুধু ব্রহ্মসঙ্গীত নয়, নানা পর্যায়ের গানেই রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদের সমাহিত ভাবটির সযত্ন লালনে সচেষ্ট থেকেছেন।

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:২৬
আনন্দ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশনে আরমান খান, তালবাদ্যে বিপ্লব মণ্ডল এবং এসরাজে অপরাজিতা চক্রবর্তী।

আনন্দ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশনে আরমান খান, তালবাদ্যে বিপ্লব মণ্ডল এবং এসরাজে অপরাজিতা চক্রবর্তী। ছবিঃ দেবকল্যাণ চৌধুরি।

কয়েক বছর আগে আনন্দ পুরস্কারের আয়োজনে রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশন করেছিলেন উস্তাদ রাশিদ খান। ১৪৩১ বঙ্গাব্দের বৈশাখী সন্ধ্যায় আনন্দ সম্মাননার পরিসরে রবীন্দ্রনাথের গানে মোহিত করলেন তাঁর নবীন পুত্র আরমান খান। মার্গ-পরিসরের শিল্পী আরমান-পরিবেশিত তিনটি গানকে সফল ‘পেশকারি’ বলা যেমন সঙ্গত, তেমনই বলা জরুরি যে, রবীন্দ্রগানের পরিবেশনায় নতুন এক তারার বিচ্ছুরণ প্রত্যক্ষ করা গেল। আরমান মাত করলেন তাঁর দুই কৃতী সতীর্থ তালবাদ্যে বিপ্লব মণ্ডল আর এসরাজে অপরাজিতাচক্রবর্তীকে নিয়ে।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে ভারতীয় মার্গগানের সম্পর্কের নানা বিশেষত্বের মধ্যে একটি ধ্রুপদকে তার ভাবার্থে সমাদর করা। শুধু ব্রহ্মসঙ্গীত নয়, নানা পর্যায়ের গানেই রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদের সমাহিত ভাবটির সযত্ন লালনে সচেষ্ট থেকেছেন। গ্রহণ করেছেন ধ্রুপদের শান্তিকে। বর্জন করেছেন বৈয়াকরণের শুষ্কতাকে। আনন্দ-সন্ধ্যার শুরুর গান রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদাঙ্গই। যে তিনটি গান পরিবেশিত হল, তার মধ্যে এই ধ্রুপদাঙ্গটি কবির মধ্যবয়সের রচনা— তিরিশের কোঠায় কবি বেঁধেছিলেন ‘অন্তরে জাগিছ অন্তরযামী’। বাকি দু’টির রচনাকালে রবীন্দ্রনাথ বাইশ-তেইশ। তার মধ্যে ‘যোগী হে, কে তুমি হৃদি-আসনে’ গানটি ধ্রুপদের পরের ধাপে বিবর্তিত খেয়ালের মতো ছোট বন্দিশ-প্রধান, রাগ-নির্ভর। অন্যটি ‘ও কেন ভালবাসা জানাতে আসে’ গানটি খেমটা। গান-বিবর্তনের ধারায় ধ্রুবপদ বা ধ্রুপদ-ভেঙে তৈরি হয়েছিল খেয়াল-গানের অপেক্ষাকৃত স্বাধীন পরিসর। পরে খেয়াল ভেঙে তৈরি হয়ে উঠেছিল ঠুমরি-খেমটার মতো তুলনায় হালকা ঠমক-বয়ান। আনন্দসন্ধ্যার পরিবেশনে মার্গগানের এই বিবর্তন-পথটিও ক্রমবিন্যাসে ধরা পড়ল।

আরমান শুরু করলেন বেহাগে বাঁধা ধ্রুপদাঙ্গ ‘অন্তরে জাগিছ অন্তরযামী’ দিয়ে। গানটিতে হিন্দি ধ্রুপদ বন্দিশ ‘কৌন যোগী ভায়ো’র ছায়া রয়েছে বলে মনে করা হয়। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে স্নাতসিক্ত শিল্পী আরমান সে-গানে ঢোকার আগে রাগরূপ প্রতিষ্ঠা করলেন। গানটি পঙ্কজকুমার মল্লিকের কণ্ঠে জোয়ারি-জোয়ার গমক-গতির জাদুমাদুর বিরচনা করে গিয়েছে। নবীন আরমান তাঁর কণ্ঠে অনুসারী মন্দ্রধারা ধারণ করে বিস্ময়াবিষ্টই করলেন। ধ্রুপদের যে-আবহ সমীহ আদায় করে থাকে, তা মূর্ত হল শিল্পীর কণ্ঠে, বিপ্লব মণ্ডলের ঝাঁপতালের পাখোয়াজ-রণনে, অপরাজিতার মাপা মিড়ে।

দ্বিতীয় পরিবেশন ‘যোগী হে, কে তুমি হৃদি-আসনে’ আরমান শুরু করলেন কেদারের মেজাজ প্রতিষ্ঠা করে। একতালের এই গানের লয় নির্বাচনেই শিল্পী গানের নাট্যমুহূর্ত নিষ্কাষণের পরিসর তৈরি করে রাখলেন। এই গানটি স্বামী বিবেকানন্দ গাইতেন বলে শোনা যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ প্রকাশিত ‘সঙ্গীত সংগ্রহ’তে গানটি সঙ্কলিত হয়েছিল। সে-গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন দিলীপকুমার রায়। গ্রন্থের ‘শ্রীশ্রীশিব সঙ্গীত’ পর্বে রবীন্দ্রনাথের এই গানটি সংকলিত ছিল (‘আলাহিয়া একতালা’ উল্লেখে এবং সম্বোধন-রীতিতে ‘যোগি হে’ করার পাশাপাশি গীতি-চলন অনুযায়ী শুরুতে দু’বার ‘যোগি হে’র লিখিত বয়ান-সহ)। কেন শিবসঙ্গীত-পর্বে রেখেছিলেন এ-গানকে দিলীপকুমারেরা, তার কিছুটা আন্দাজ মিলল আরমানের গায়কিতে। পাখোয়াজের বোল আর গায়কির মেলবন্ধনে ‘বিভূতিভূষিত’ মাধুর্যের আভাস ছিলই।

তৃতীয় গানটি পিলু— ‘ও কেন ভালবাসা জানাতে আসে’। এ-গানের আলাদা পরিচয়— গানটি পিলু-খেমটা। শুরুতেই অনুপম মজলিশ-আবহ রচনা করলেন অপরাজিতা তাঁর এসরাজে। আরমান অল্প বোলতান-সহকারে ঢুকলেন। গান খেমটার মধুব্যূহে পড়ল বিপ্লবের তবলার ঠুমরি-ঠেকায়। রবীন্দ্রস্পর্শে যে-পিলু ‘ও চাঁদ, চোখের জলের লাগল জোয়ার’ হয়ে উঠতে পারে, সেই পিলুই চার পঙ্‌ক্তির এই খেমটার অনিন্দ্য বিরচনা করতে পারে। কমবয়সি রবীন্দ্রনাথের চার পাশে যে একদা মেটিয়াবুরুজের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের পূর্বি ঠুমরি উড়ে বেড়াত, তাঁর কাছের পাড়ার প্রতিবেশী যে ছিলেন গওহরজান, তা সময় বিস্মৃত হলেও আরমানের পেশকারি তারও উত্তরাধিকারের স্পর্শ রাখল।

আনন্দসন্ধ্যায় আরমান কবির যে নবীনকালের গান গাইলেন, ঠিক সেই বয়সকালেই তিনি নিজে এখন। রবীন্দ্রগানের ভাবজগতের শরিক হওয়ার চেষ্টা, স্পষ্ট উচ্চারণ এবং মন্দ্র থেকে তারসপ্তক ছুঁয়ে যাওয়ার কঠিন-সহজিয়া পরিভ্রমণে আরমান খান শ্রোতার আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দিলেন আনন্দ পুরস্কারের সন্ধ্যায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Prize song

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy