লাগাতার হামলার মুখে শাসক দলের অসহিষ্ণুতাকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন বাম নেতৃত্ব। তবে মার খেয়ে কিছু জায়গায় পাল্টাও দিতে শুরু করেছে সিপিএম! যা দেখে অনেকে মনে করছেন, এই ঘটনাপ্রবাহ এক দিকে যেমন বিধানসভা ভোটের আগে বাংলার রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার অশনি সঙ্কেত দিচ্ছে, তেমনই তার অভিঘাত পৌঁছে যাচ্ছে জাতীয় স্তরেও। বস্তুত, দু’দিন আগেই পটনায় নীতীশ কুমারের শপথ অনুষ্ঠানের পর চা-চক্রে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির কাছে রাহুল গাঁধী জানতে চেয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের কী খবর? জবাবে ইয়েচুরি তাঁকে নিজের মোবাইল থেকে সে দিনই সূর্যবাবুদের জাঠায় হামলার ছবি দেখিয়ে বলেন, বাংলায় শাসক দলের ‘সহিষ্ণুতা’র এই হচ্ছে নমুনা! এর পরে সিপিএম নেতৃত্ব ঠিক করেছেন, সংসদের আসন্ন অধিবেশনেও তাঁরা জাঠায় হামলার প্রসঙ্গ তুলবেন। দেশ জু়ড়ে অসহিষ্ণুতার আবহের পরিপ্রেক্ষিতে বিতর্ক চেয়ে সংসদে ইতিমধ্যেই নোটিস দিয়েছে তৃণমূল-সিপিএম, দু’পক্ষই। সিপিএমের সংসদীয় দলনেতা মহম্মদ সেলিমের কথায়, ‘‘তৃণমূলের মুখে যে অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদ মানায় না, জাঠার উদাহরণ দিয়েই আমরা সেটা বলব।’’
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মানতে নারাজ। দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও অন্যতম সংখ্যালঘু মুখ ফিরহাদ হাকিম এ দিন যৌথ বিবৃতি জারি করে সন্ত্রাস ছড়ানোর জন্য পাল্টা কাঠগড়ায় তুলেছেন বামেদেরই! পার্থ-ফিরহাদ বলেছেন, ‘‘সন্ত্রাসের পুরনো দিন আর ফিরিয়ে আনতে দেওয়া হবে না। ৩৪ বছর ধরে বাংলার মানুষ এদের দেখেছে, চিনেছে, জেনেছে! সন্ত্রাস তৈরির চেষ্টার প্রতিবাদ জনগণ করবে, প্রশাসনও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’’ দুই মন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘‘রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল করার অধিকার সকলেরই আছে। কিন্তু তার আড়ালে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করা হলে বরদাস্ত করা হবে না!’’ গ্রামে বা শহরে, বুথ-ভিত্তিতে পদযাত্রা হলে সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি হবে কেন, তার উত্তর অবশ্য তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছ থেকে মেলেনি। কোথাও কোথাও আবার শাসক দলের নেতারা বামেদের ‘অন্তর্দ্বন্দ্বের’ উপরেই দোষ চাপিয়েছেন!
পার্থবাবুরা যা-ই হুঁশিয়ারি দিন, রাজ্যে বিধানসভা ভোটের আগে কলকাতায় আসন্ন প্লেনামকে সামনে রেখে স্থানীয় স্তরে সংগঠনের জড়তা কাটিয়ে কর্মীদের রাস্তায় বের করে আনতে পারাটা সিপিএমের পক্ষে যেমন উৎসাহজনক, তেমনই তাঁদের উপরে হামলার ঘটনায় শাসক দলের ভয় পেয়ে যাওয়ার বার্তাই ছড়িয়ে যাচ্ছে বলে আলিমুদ্দিনের ব্যাখ্যা। বাম নেতাদের অভিযোগ, বিধানসভা ভোটের মুখে বিরোধী শক্তির মাথাচাড়া দেওয়া অঙ্কুরে বিনাশ করতেই উপর্যুপরি এমন হামলা শুরু করেছে তৃণমূল।
জাঠায় যোগ না দিলেও পরিস্থিতির নিরিখে এসইউসি বা লিবারেশনের মতো বাম দলগুলিও তৃণমূলের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। তার উপরে সূর্যবাবুদের বাড়তি স্বস্তির কারণ, শহর ও গ্রামের নানা জায়গায় মহিলা-সহ সাধারণ মানুষের একাংশ বেরিয়ে এসে প্রতিরোধে সামিল হচ্ছেন। যেমন হয়েছে এ দিন খাস কলকাতার ৭৭ ও ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডে। জাঠা শেষের পরে ফরওয়ার্ড ব্লকের দুই সমর্থকের উপরে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা চপার নিয়ে হামলা করে বলে অভিযোগ। পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতার করার পরে দুষ্কৃতী বাহিনী একবালপুর থানা থেকে তাদের ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলেও বামেদের অভিযোগ। এলাকার মহিলারাই বেরিয়ে এসে সেই চেষ্টা প্রতিহত করেন। তৃণমূলের তরফে কেউ অবশ্য এ নিয়ে মুখ খোলেননি।
সিপিএমের অভিযোগ, এ দিন বিকেলে তারকেশ্বরে তৃণমূলের বাইক-বাহিনী মিছিলে হামলা চালায়। দলের প্রাক্তন সাংসদ শক্তিমোহন মালিক-সহ বেশ কয়েক জন জোনাল কার্যালয়ে ঢুকে পড়েন। তৃণমূলের প্রচুর লোক সেখানে জড়ো হয়। ভাঙচুর, আগুন— কিছুই বাদ থাকেনি। শক্তিমোহনবাবুরা কার্যালয়ের দোতলায় উঠে গ্রিল আটকে দেন। সিপিএমের হুগলি জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরীর অভিযোগ, ‘‘থানার বড়বাবু তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে নিয়ে আসেন।’’ জেলার এক পুলিশ কর্তার যদিও দাবি, ‘‘খবর পেয়েই পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।’’ জেলা তৃণমূল সভাপতি তপন দাশগুপ্তের পাল্টা দাবি, ‘‘ওরা আমাদের ছেলেদের মারধর করে। পরে নিজেদের পার্টি অফিসে কয়েকটা খবরের কাগজ পুড়িয়ে দেয়! ঘটনার প্রতিবাদে সোমবার মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম তারকেশ্বরে সভা করবেন।’’ সুদর্শনবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘তৃণমূল স্বৈরতন্ত্র ও মিথ্যাচারে রেকর্ড করছে!’’
বর্ধমানের জামুড়িয়ার বালানপুর গ্রামে এ দিন বামেদের জাঠা ঢোকার সময়ে বোমাবাজি হয় বলে অভিযোগ। তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে বচসার সময়ে স্থানীয় সিপিএম বিধায়ক জাহানারাকে ধাক্কা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। মারধর করা হয় দলের চার কর্মীকে। বারাবনির পানুড়িয়াতেও সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষ বাধে। ভাঙচুর হয় তৃণমূল কর্মীদের বেশ কয়েকটি বাইক। গণ্ডগোল থামাতে গিয়ে মাথায় ইটের আঘাতে জখম হন এক পুলিশকর্মী। ঘটনাস্থল থেকে এক সিপিএম কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
শনিবার ময়ূরেশ্বরে জাঠায় হামলায় নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এলাকায় তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত সিভিক ভলান্টিয়ার রামচন্দ্র বাগদির বিরুদ্ধে। হামলায় জখম হয়ে সিউড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক ধীরেনবাবু এ দিন বলেন, ‘‘মারধরের পরে ওরা জাম খুলে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। মান বাঁচাতে হাতে-পায়ে ধরি। তখনই ওই রাম বাগদি কান ধরে ওঠবোস করিয়ে মোবাইলে তুলে রাখে।’’ ওই রাতেই রামচন্দ্র-সহ ১০ জন তৃণমূল কর্মীর নামে খুনের চেষ্টার অভিযোগ করেন সিপিএম বিধায়ক অশোক রায়। এ দিন রাত পর্যন্ত অবশ্য কেউ ধরা পড়েনি। তারই মধ্যে এ দিন আবার ময়ূরেশ্বরের শিবগ্রামে বিজেপির মিছিলে হামলার অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের বিরুদ্ধে।