Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

গরু পাচারের দলে ভিড়ে জামাত জঙ্গি এ-পারে

গরুর লেজ ধরে বৈতরণী পেরোনো নয়। গরু পাচারকারীদের লেজুড় হয়ে সীমান্ত পারাপারের ব্যাপারটাই মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে গোয়েন্দাদের। ওই পাচারকারীদের সঙ্গে এমন কিছু লোক ও-পার বাংলা থেকে এ রাজ্যে চলে আসছে, যাদের নিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারাও চিন্তিত।

সুনন্দ ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

গরুর লেজ ধরে বৈতরণী পেরোনো নয়। গরু পাচারকারীদের লেজুড় হয়ে সীমান্ত পারাপারের ব্যাপারটাই মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে গোয়েন্দাদের। ওই পাচারকারীদের সঙ্গে এমন কিছু লোক ও-পার বাংলা থেকে এ রাজ্যে চলে আসছে, যাদের নিয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারাও চিন্তিত।

তারা কারা? চিন্তাই বা কীসের?

গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, তারা মাঝারি মাপের জামাত-জঙ্গি নেতা। তারা দুই ২৪ পরগনার বেশ কিছু ভারতীয় যুবককে কাজে লাগাচ্ছে। ওই ভারতীয় যুবকেরা মূলত গরু পাচারের সঙ্গে জড়িত। বনগাঁ ও বসিরহাটের বিস্তীর্ণ এলাকা দিয়ে গরু পাচার হয়। গোয়েন্দা সূত্র জানাচ্ছে, গরু বাংলাদেশে পৌঁছে দেওয়ার পরে পাচারকারীরা যখন খালি হাতে এ দেশে ফিরছে, তাদের দলে ভিড়ে যাচ্ছে জামাত নেতারাও। গরু পাচারকারীরা ঝামেলা-ঝক্কি এড়িয়ে যখন-তখন সীমান্ত পারাপারের সুলুকসন্ধান জানে। ওই পাচারকারীদের হাত ধরে অনায়াসে সীমান্ত টপকে ভারতে আসা যায় বলেই তাদের শরণ নিয়েছে জামাত-জঙ্গিরা। তাদের সঙ্গে আসছে বাংলাদেশি টাকাও। সেই টাকা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে এ রাজ্যে লুকিয়ে থাকা জামাত নেতা এবং তাদের সাহায্যকারী যুবকদের কাছে।

জামাত-জঙ্গিদের এ-পারে চলে আসার মূলে দু’টি কারণ চিহ্নিত করেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। প্রথমত, আপাতত বাংলাদেশে থাকা বিপজ্জনক বলে মনে করছে ওই জঙ্গিরা। খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের পরে বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগ (র‌্যাব)-এর অফিসারেরা এ দেশে এসে খাগড়াগড় কাণ্ডে ধৃতদের জেরা করে বেশ কিছু তথ্য পান। তার পরেই বাংলাদেশে জামাত-জঙ্গিদের ধরপাকড় বেড়ে যায়। খাগড়াগড় কাণ্ডের এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘বাংলাদেশের মাটি এখন জামাত নেতাদের পক্ষে খুব একটা নিরাপদ নয়। তাদের অনেকে তাই ভারতে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে।’’

দ্বিতীয় কারণটা পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা দেশ এবং ও-পার বাংলার পক্ষেও বিপজ্জনক। পালিয়ে আসা জামাত-জঙ্গিদের থেকে বিপদ কতটা, জানাচ্ছেন রাজ্য পুলিশের এক অফিসার। তিনি বলেন, ‘‘সন্দেহ করা হচ্ছে, এখানে নতুন ঘাঁটি বানিয়ে বাংলাদেশে জামাতের কাছে অস্ত্র ও বিস্ফোরক পাঠানোই ওদের মূল উদ্দেশ্য।’’ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা সতর্ক করে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে। এক বোমা বিস্ফোরণেই তছনছ হয়ে গিয়েছিল জঙ্গিদের ‘খাগড়াগড় মডেল’। এ দেশে লুকিয়ে থেকে জামাত-জঙ্গিদের বিস্ফোরক বানানোর কারিকুরি ধরা পড়ে গিয়েছিল। ধরা পড়ে কিছু জঙ্গি। পালিয়েও যায় অনেক সন্ত্রাসবাদী।

খাগড়াগড় কাণ্ডের বয়স মাত্র ন’মাস। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, এর মধ্যেই জামাত-জঙ্গিরা এ রাজ্যে নতুন একটি ‘মডেল’ গড়ে তুলতে কোমর বেঁধে নেমেছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, গত দু’তিন মাস ধরে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলা থেকে বেশ কিছু জামাত নেতা-কর্মী উত্তর ২৪ পরগনা দিয়ে এ-পারে এসে গা-ঢাকা দিয়েছে নানা এলাকায়। গোয়েন্দাদের মতে, খাগড়াগড়ে যখন তারা ডেরা বেঁধেছিল, সেই সময় ব্যবহার করা হয়েছিল বর্ধমান, বীরভূম, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ জেলাকে। এ বার আপাতত উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনাকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য জেলায়। বেশ কয়েক জন নেতা আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী রাজ্যেও।

গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, ন’মাস আগে (খাগড়াগড় কাণ্ডের আগে) বর্ধমান, বীরভূম, নদিয়া, মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন ডেরা থেকে বাংলাদেশে জামাতের কাছে অস্ত্র ও বিস্ফোরক পাঠানো হত। ‘‘চুপচাপ বসেই তখন কাজ চলছিল। খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ না-হলে আজও হয়তো জামাতদের ওই সব ডেরার কথা জানা যেত না,’’ বলছেন এক গোয়েন্দাকর্তা।

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ জঙ্গিদের অনেক ছক ভেস্তে দিয়েছে। নতুন ছকে ফের একই কাজ করতে চাইছে তারা। তাই এই দফায় পালিয়ে আসা জামাত-জঙ্গিরা এখানে চুপ করে বসে আছে, এমন ভেবে নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা ঠিক হবে না। আসলে এ রাজ্যে সংগঠন বাড়িয়ে, খাগড়াগড় মডেলে বাংলাদেশের জামাতকে সাহায্য করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আবার এ রাজ্যের বিভিন্ন লুকোনো ডেরায় বসে বিস্ফোরক তৈরি করা হবে। আমদানি করা হবে অস্ত্রশস্ত্র। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা ওই জামাত নেতাদের সম্পর্কে পড়শি দেশের গোয়েন্দারাও সতর্ক করে দিয়েছেন দিল্লিকে।

খাগড়াগড় কাণ্ডে অভিযুক্তদের মধ্যে ২১ জন এখন জেলে বন্দি। ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এখনও কমবেশি ১৫ জনকে খুঁজছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)। কিন্তু গোয়েন্দাদের মতে, তাদের সকলেই দাবার বোড়ে। বড়সড় মাথাদের কেউই ওই ধৃত বা পলাতকদের তালিকায় নেই। সেই চাঁইয়েরা বাংলাদেশে বসেই কলকাঠি নাড়ছে এবং তারাই পশ্চিমবঙ্গে নতুন ডেরার সন্ধানে নেমেছে। সেই জন্যই মাঝারি মাপের জামাত নেতাদের এ-পারে পাঠাচ্ছে তারা। এ দেশের যারা সেই কাজে জামাতকে সাহায্য করছে, তাদের কয়েক জনের নাম-ঠিকানাও তুলে দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের হাতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE