E-Paper

প্রকাশ্যেই বিকোচ্ছে নিষিদ্ধ বাজি, ঘরে ঘরে স্তূপীকৃত বারুদ

২০২৩ সালের ২৭ অগস্ট বারাসত-ব্যারাকপুর রোডের নীলগঞ্জ সংলগ্ন মোচপোলে বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছিল ন’জনের। বিস্ফোরণের তীব্রতায় বাড়ির ছাদ মাটিতে মিশে গিয়েছিল।

চন্দন বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৪২
পসরা: দেদার বিকোচ্ছে থরে থরে সাজানো বাজি। দত্তপুকুর থানার নীলগঞ্জ নারায়ণপুরে।

পসরা: দেদার বিকোচ্ছে থরে থরে সাজানো বাজি। দত্তপুকুর থানার নীলগঞ্জ নারায়ণপুরে। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

রাস্তার দু’পাশেই নানা ধরনের বাজির দোকান। তাই সরু রাস্তা আরও সরু হয়ে গিয়েছে। বাড়ির মহিলা থেকে নাবালক সন্তান— দোকানে খদ্দের সামলাতে সকলেই উপস্থিত। সামনে দাঁড়িয়ে দু’-একটি বাজি দেখা শুরু করতেই দোকানের ভিতর থেকে চাপা গলায় আওয়াজ এল, ‘‘আপনি পছন্দ করুন! এখানে যা দেখছেন না, সেই চকলেট, সেল সব পেয়ে যাবেন। এমন মাল দেব, আওয়াজে সারা গ্রাম কাঁপবে।’’

কিছু ক্ষণ পরে সেই লুকনো ‘মাল’ দেখতে চাইতেই দোকানি মহিলা চোখের ইশারা করলেন। যা দেখেই এক নাবালক দৌড়ে গিয়ে পিছনের বাড়ি থেকে বড়সড় আকারের চকলেট বোমা নিয়ে এল। সেটি হাতে নিয়ে মহিলা বললেন, ‘‘স্পেশাল এই ‘মাল’ শুধু এখানকার কয়েকটি ঘরেই তৈরি হয়। বাকিরা আমাদের থেকে নিয়েই বিক্রি করছে। লুকিয়ে এক বার শুধু বাড়ি নিয়ে যান। ফাটানোর পরে আমার নাম করবেন!’’

২০২৩ সালের ২৭ অগস্ট বারাসত-ব্যারাকপুর রোডের নীলগঞ্জ সংলগ্ন মোচপোলে বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছিল ন’জনের। বিস্ফোরণের তীব্রতায় বাড়ির ছাদ মাটিতে মিশে গিয়েছিল। উড়ে গিয়েছিল পাশের দোতলা এবং রাস্তার ধারের একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির একাংশ। সেই ঘটনার ‘ক্ষত’ সারিয়ে বিস্ফোরণস্থলের দু’পাশের বাড়িগুলি আবার ফিরেছে পুরনো চেহারায়। ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে আবার তৈরি করা হয়েছে টিন দিয়ে ঘেরা ছোট্ট ছাউনি। স্থানীয় এক মহিলা বললেন, ‘‘বিস্ফোরণে বাড়ির মালিক সামসুল হকের মৃত্যু হয়েছিল। ঘটনার পর থেকে তাঁর ছেলেরা বেপাত্তা ছিল। মাসকয়েক আগে ফিরে এসে তারা টিন দিয়ে ছোট্ট একটা ছাউনি তৈরি করেছে।’’ তবে, সামসুলের ছেলেরা কেউ সেখানে থাকেন না।এমনকি, মোচপোলের ওই এলাকায় বেআইনি বাজির ব্যবসাও আপাতত বন্ধ হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, সেই সময়ে মোচপোল ও নারায়ণপুর ছিল কার্যত বেআইনি বাজির আড়ত। কয়েক জন প্রভাবশালীর মদত থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা সব জেনেও চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ওই বিস্ফোরণ রাতারাতি মোচপোলের বাসিন্দাদের ভয় ভেঙে দিয়েছিল। সেই প্রভাবশালীদের বাড়ি ভাঙচুরের পাশাপাশি কার্যত তাঁদের এলাকাছাড়া করেছিলেন গ্রামবাসীরা। স্থানীয় বাসিন্দা আমজাদ আলির কথায়, ‘‘কয়েক জনের বাড়ি এবং ইটের গোলার আড়ালে চলা বাজি কারখানায় ভাঙচুর হয়। অনেকে এলাকাছাড়া ছিলেন। তাঁদের অনেকেই ফিরে এসেছেন। কিন্তু কেউ আর নতুন করে এলাকায় মারণ ব্যবসা শুরু করার সাহস দেখাননি।’’

মোচপোল ঠেকে শিখলেও নারায়ণপুর শেখেনি। দত্তপুকুর থানা এলাকার মোচপোল থেকে মেরেকেটে আড়াই কিলোমিটার দূরে নারায়ণপুর জুড়ে বেআইনি বাজির রমরমা ব্যবসা চলছে। কয়েকশো মিটারের মধ্যে রাস্তার দু’পাশে সারি সারি অসংখ্য দোকান। অনেকের বাড়িতেই দেখা গেল, বিপজ্জনক ভাবে বারুদ মজুত করা হয়েছে। প্রকাশ্যেই বিকোচ্ছে চকলেট বোমা থেকে নিষিদ্ধ শব্দবাজি। নারায়ণপুরের সরু রাস্তা ধরে কিছুটা এগিয়ে যেতেই কম বয়সি এক যুবক গাড়ি দাঁড় করালেন।বাজি কিনতে এসেছি কিনা জানতে চেয়ে বললেন, ‘‘আমি নিজের হাতে বাজি বানাই। আপনি সব দোকান ঘুরে আসুন। কেনার আগে শুধু আমার কাছে এসে এক বার দরদাম করে যাবেন।’’

এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেল, মোচপোলে বিস্ফোরণের প্রভাব এসে পড়েছিল নারায়ণপুরেও। রাতারাতি সেখানেও বেআইনি বাজির ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসা বদল করে অনেকে এলাকায় মুদিখানার দোকান খুলে বসেছিলেন। কিন্তু বছর না ঘুরতেই কার্যত সেই ছবি পাল্টে যায়। জানা গেল, গত বছর কালীপুজোর সময় থেকেই গোপনে বেআইনি বাজি তৈরি এবং বিক্রি শুরু হয়েছিল। এ বছর সেই আড়ালও কার্যত উঠে গিয়েছে। যদিও বেআইনি বাজির ব্যবসা নিয়ে প্রশ্ন করতেই স্থানীয় এক মহিলা দোকানি কোনও রাখঢাক না করেই বললেন, ‘‘এই এলাকা তো বাজির জন্যই সবাই চেনে। এখানে অন্য কী ব্যবসা করব? জানি, ভয় আছে। কিন্তু পেটও তো চালাতে হবে।’’

কিন্তু পুলিশ কি কিছুই জানে না? জেলা পুলিশের এক কর্তা অবশ্য দাবি করলেন, ‘‘বেআইনি বাজি বাজেয়াপ্ত এবং ধরপাকড় চলছে। নারায়ণপুরেও অভিযান চালানো হয়েছে।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Crackers deepabali Diwali kalipuja

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy