Advertisement
E-Paper

মোহনভোগবিহীন কাটোয়া লোকাল ভাবা যায় না

ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় আলাদা পরিবেশে নানা ধরনের পণ্য দেখতে পান যাত্রীরা। তবে আমাদের দেশের যে কোনও রেলপথে অন্তত দু’টি জিনিস দেখতে পাওয়া যাবেই। এক, গরম চা। দুই, খবরের কাগজ।

পুলক মণ্ডল

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:০৬
চলছে মোহনভোগের বেচাকেনা। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল

চলছে মোহনভোগের বেচাকেনা। ছবি: জাভেদ আরফিন মণ্ডল

লোকাল ট্রেনের কামরায় শুধু চা আর ঝালমুড়ির আনাগোনা হয় না; নানা বর্ণের, নানা গন্ধের টক-ঝাল-মিষ্টি খাবার থেকে শুরু করে কত ধরনের জিনিসই না পাওয়া যায়— যাদের সঙ্গে জড়িত থাকে স্থানীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য। লোকাল ট্রেনের কামরা তাই এক মিশ্র সংস্কৃতির ক্ষেত্র।

ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় আলাদা পরিবেশে নানা ধরনের পণ্য দেখতে পান যাত্রীরা। তবে আমাদের দেশের যে কোনও রেলপথে অন্তত দু’টি জিনিস দেখতে পাওয়া যাবেই। এক, গরম চা। দুই, খবরের কাগজ। কিন্তু এমন কিছু জিনিসের হকারি করতে বিশেষ রেলপথে দেখতে পাওয়া যায় যা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। যেমন ‘মোহনভোগ’। পূর্ব রেলের ব্যান্ডেল-কাটোয়া রেলপথে যাঁরা যাতায়াত করেন, তাঁরা মোহনভোগের সঙ্গে বিশেষ ভাবে পরিচিত। যদিও শুধু মোহনভোগ নয়, স্বাদে-বর্ণে-গন্ধে অতুলনীয় এত ধরনের মিষ্টি এই রেলপথে চলা লোকাল থেকে এক্সপ্রেস সবেতেই মেলে যে অনেক নিত্যযাত্রীই আদর করে ব্যান্ডেল-কাটোয়া লোকালকে ‘খাই-খাই লোকাল’ বা মজা করে ‘মিষ্টি চাই লোকাল’ বলেও ডাকেন।

হাওড়া থেকে কাটোয়া মেন লাইনের দূরত্ব ১৪৪ কিলোমিটার আর ব্যান্ডেল থেকে ১০৪ কিলোমিটার। দিনে ২১ জোড়া লোকাল চলে। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনকারী খান দশেক দূরপাল্লার ট্রেন চলে। ব্যান্ডেল থেকে কাটোয়া এই যাত্রাপথে ২৮টি স্টেশন পড়ে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি এক দিকে যেমন ছোটখাটো ভ্রমণের জন্য দীর্ঘদিন ধরে বিশেষ পরিচিত নাম, তেমনই বেশ কয়েকটি এলাকার বিশেষ বিশেষ উৎসবের জন্য যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে। নবদ্বীপ-মায়াপুর, ১০৮ শিবমন্দির খ্যাত কালনা, পূর্বস্থলীর চুপি পাখিরালয়, গুপ্তিপাড়ার রথ, অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ মেলা, সমুদ্রগড়ের বাউল গানের আসর কিংবা বৈষ্ণবতীর্থ কাটোয়া দেখতে এই রেলপথে নিত্যযাত্রী ব্যতিরেকে আরও অসংখ্য মানুষ আসেন প্রতি দিন। ব্যান্ডেল-কাটোয়া লোকালও তার যাত্রীদের বঞ্চিত করে না মিষ্টির স্বাদ থেকে।

কথা হচ্ছিল মোহনভোগ নিয়ে। ‘মোহনভোগ’ শব্দের বাংলা অর্থ, সুজি-চিনি-দুধ প্রভৃতি দ্বারা তৈরি পায়েস বিশেষ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’–তে আছে, ‘খানিকটা পরে বধূ মোহনভোগ তৈরি করে তাকে খেতে দিল। একটা বাটিতে অনেকখানি মোহনভোগ—এত ঘি দেওয়া যে আঙুলে মাখামাখি হয়ে যায়। অপু একটুখানি মুখে তুলে খেয়ে অবাক হয়ে গেল—এমন অপূর্ব’।

তবে ব্যান্ডেল-কাটোয়া লোকালের মোহনভোগ কিন্তু পায়েস নয়। এটা দেখতে অনেকটা রসগোল্লা ধরনের, খানিক হলুদাভ। তৈরি হয় ছানা, চিনি, এলাচের দানা, দুধ দিয়ে। এক সময় সুগন্ধের জন্য গোলাপ জলও দেওয়া হতো। মোহনভোগ কিনলে ‘ফ্রি’-তে জল
পাওয়া যাবে। ট্রেন থামলেই দ্রুত প্ল্যাটফর্মের কলে জলের ক্যান ভরে নিয়ে হকারেরা চলে যান পরের কামরায় বাঁধা খদ্দেরের কাছে। কাজের সূত্রে নিত্য যাতায়াতের কারণে অনেকেই কোনও না কোনও মোহনভোগ হকারের বাঁধা খদ্দের।

নবদ্বীপের সুবল মণ্ডল, কালনার বাসু ঘোষ, সোমরাবাজারের খোকন সরকার, খামারগাছির সুবল বিশ্বাস প্রমুখের মোহনভোগের খ্যাতির সুগন্ধ এক সময় কামরা থেকে কামরায় ছড়িয়েছে। মোহনভোগ বিহীন ব্যান্ডেল-কাটোয়া লোকাল এক সময় কেউ ভাবতেই পারতেন না। এখনও মোহনভোগ আছে। এখনও মোহনভোগ ছা়ড়া, কাটোয়া লোকাল ভাবা যায় না। কিন্তু কোথায় যেন একটা বিষাদের সুর! মোহনভোগ হকারের সংখ্যা যেন দিন দিন কমছে।

কারণটা কী? নবদ্বীপের কাছাকাছি সমুদ্রগড়ের বাসিন্দা মোহনভোগ হকার বিনুদা বলছিলেন, ‘‘মোহনভোগের সেই দিন আর নেই। ত্রিশ বছর হকারি করছি এই লাইনে, কিন্তু যে মোহনভোগের দৌলতে এত কাল সংসার চালিয়ে এসেছি এখন তার জায়গা নিয়েছে ভাজাভুজি।’’ ভাজাভুজি মানে! বিশুদা বললেন, ‘‘পপকর্ন, আলুর চিপস্, কুড়কুড়ে এই সব প্যাকেটের ভাজা আর কি!’’ স্বগতোক্তির ঢং-এ ত্রিশ বছরের মোহনভোগ হকার বলে উঠলেন, ‘‘আরে বাবা, সকালবেলা চারটে মোহনভোগ খেয়ে ঢক ঢক করে এক পেট জল খাবি, ব্যাস বেলা বারোটা পর্যন্ত খিদের বালাই থাকবে না! তা নয়, ফোলানো প্যাকেট ছিঁড়ে একটা একটা করে মশলাভাজা মাল। ওতে কি আর পেট ভরে? যে ক’টা দিন পারব, মোহনভোগ নিয়েই ট্রেনে উঠব। যা আছে কপালে দেখা যাবে।’’

মোহনভোগের দিন একেবারেই যায়নি। মোহনভোগের ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে অনেকটা যেন স্বেচ্ছায় নিজেদের কাঁধে দায়িত্ব তুলে নিয়েছে কাটোয়া লোকালের যুগলবন্দি— কাঁচাগোল্লা আর ক্ষীরমোহন। নয়-নয় করে চার দশক ধরে এই দুই মিষ্টি সঙ্গ দিয়ে চলেছে কাটোয়া লোকালের মোহনভোগকে। তাই যাত্রীর হাতে যত্ন করে ছোট শালপাতার যে ঠোঙা হকার তুলে দেন, তাতে দুটো কাঁচাগোল্লা কিংবা ক্ষীরমোহনের সঙ্গে দুটো মোহনভোগও দেখতে পাওয়া যায়। যাত্রীও স্বাদে বৈচিত্র্য পান, তাঁর রসনাও তৃপ্ত হয়। কাটোয়া লোকালের আরও এক ট্রেডমার্ক মিষ্টি ‘খাস পান্তুয়া’। সুস্বাদু, মোলায়েম এই পান্তুয়াও অন্যত্র পাওয়া কঠিন।

কাটোয়া লোকালে মোহনভোগের নিয়মিত হকার বাদল জানাচ্ছেন, তাঁর বাবা দিনে ৩০-৩৫ কেজি মোহনভোগ বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন আর ততটা হয় না। তাই পাঁচমেশালি মিষ্টি সঙ্গী করে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটোয়া লোকালে সময় কাটে বাদলের।

লেখক সংস্কৃতিকর্মী ও শিক্ষক

মোহনভোগ Sweet Mohan Bhog Bardhaman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy