Advertisement
১৮ মে ২০২৪

মোটরবাইকের নেশাটাই কাল হল

দিদি, ভাগ্নে-ভাগ্নীকে খানিকটা জোর করেই মোটরবাইকে চড়িয়ে বাসে তুলে দিতে যাচ্ছিলেন ভাই। বাড়ির লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্টটাও পড়েননি। হেলমেট তো আরও দূর। আচমকা বালিবোঝাই ডাম্পারের ধাক্কায় বদলে গেল সবটা।

শোকার্ত। মঙ্গলকোটের নমোপাড়ায় ইসমাতারার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ছবি: উদিত সিংহ।

শোকার্ত। মঙ্গলকোটের নমোপাড়ায় ইসমাতারার শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ছবি: উদিত সিংহ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বর্ধমান শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:৫৪
Share: Save:

দিদি, ভাগ্নে-ভাগ্নীকে খানিকটা জোর করেই মোটরবাইকে চড়িয়ে বাসে তুলে দিতে যাচ্ছিলেন ভাই। বাড়ির লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্টটাও পড়েননি। হেলমেট তো আরও দূর। আচমকা বালিবোঝাই ডাম্পারের ধাক্কায় বদলে গেল সবটা।

বর্ধমান শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বর্ধমান-কাটোয়া রোডের উপর ছ’মাইল মোড়। তার আগেই শিবপুর বাসস্টপ থেকে পূর্ব দিকে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে নতুনগ্রামে। কিছুটা এগিয়ে লস্কর দিঘি। সেখানে বসে এক প্রবীণের স্বগোতোক্তি, “লুঙ্গি পরে চার জনকে নিয়ে মোটরবাইক চালানো দেখেই বিপদ টের পেয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করায় বলল, বাসস্টপ থেকেই চলে আসবে। যাওয়াটাই কাল হল।’’

বাড়ির ভিতর তখন কান্নার রোল। ছেলে, মেয়ে, নাতি-নাতনিকে এক ঝটকায় হারিয়ে সবাই কেমন যেন বিহ্বল। তার মধ্যেই এক আত্মীয় জানান, বাড়ির ছোট ছেলে সাইফুলের খুব গাড়ির নেশা ছিল। সুযোগ পেলেই গাড়ি চালাত। সেই বাইক চালাতে গিয়েই নিজে তো গেলই, দিদি ইসমাতারা বিবি, ভাগ্নে আসলম মোল্লা ও ভাগ্নি আমিনা খাতুনও আর বাড়ি ফিরল না।

ইসমাতারার শ্বশুরবাড়ি, পড়শিরাও চার জনকে এক সঙ্গে হারানো মেনে নিতে পারছেন না। স্বামী ইউসুফ মোল্লা দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর থেকেই অসুস্থ। বর্ধমান মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়েছে তাঁকে। চিকিৎসকরা জানান, ইউসুফ কখনও হাসছেন, কখনও কাঁদছেন। কোনও কথার জবাব তিনি দিচ্ছেন না। দিনমজুর ইউসুফের বাড়ি, মঙ্গলকোটের নমোপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, মাটির দেওয়াল, খড়ের চাল। জানা যায়, ছেলে আসলাম স্থানীয় মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত আর মেয়ে আমিনা তৃতীয় শ্রেণিতে। মা ইসমাতারাই তাঁদের নিয়ম করে পড়াতেন। নতুনগ্রামের এক পড়শি বলেন, “ইসমাতারাদের পারিবারিক অবস্থা তেমন ভাল ছিল না বলে আসলম ছোট থেকে আমাদের এখানে থাকত। ছেলেকে নিজে পড়াবে বলে ফাইভে ভর্তি হওয়ার পরেই মঙ্গলকোট চলে যায়।” বানু বিবি, সফিউনারা বেগমরাও বলেন, “বিকেল বেলা এক সঙ্গে গল্প করতাম। পরিবারের সঙ্গে আমাদেরও ফাঁকা করে দিয়ে গেল।” আরেক পড়শি ফিরোজা বিবি বলেন, “সংসারের অন্ধকারেও ইসমাতারার মুখে কিন্তু হাসি লেগেই থাকত।”

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সাইফুলের দাদা হাসিবুল ন’মাস আগে মোটরবাইকটি কিনেছিল। মাস দু’য়েক আগে কেরল থেকে আসার পর থেকেই সুযোগ পেলেই তা নিয়ে ধাঁ হয়ে যেত সাইফুল। এ দিনও দিদিদের জোর করেই মোটরবাইকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু বাইক চালানোর ঠিকটাক জামাকাপড়, হেলমেট? সাইফুলের বাবা আবু কালাম বলেন, “বাস আসতে দেরি করছে দেখে লুঙ্গি পরেই দিদিদের মঙ্গলকোটে নামাতে চলে গিয়েছিল। মেয়ের আধার কার্ড করানোর ছিল। কী যে হয়ে গেল!”

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, চাপ চাপ রক্ত পড়ে। কাঁচের টুকরো, চাল, জুতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। নওয়াপাড়া বাসস্টপের আগে পর্যন্ত রক্তের দাগ রাস্তায়। ছেঁচড়ানোরও চিহ্নও স্পষ্ট। কী করে হল এমনটা? প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, “পুলিশ টাকা তোলার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। অথচ থানার সামনে দিয়ে বালির গাড়ি ধরে না পুলিশ। তার ফলেই এ রকম দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে।” একই অভিযোগ মৃতার শ্বশুরবাড়িরও। এ দিন মঙ্গলকোট থানায় বিক্ষোভ দেখান তাঁরা। নমোপাড়ার বাসিন্দাদের অভিযোগ, “পুলিশের যোগসাজসে একদিকে বালির কারবার চলছে, অন্য দিকে ন্যূনতম প্রশিক্ষণ ছাড়াই ডাম্পার বা লরি চালাতে নেমে পড়ছে। ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছে।” অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, “বালির গাড়ি না হয়ে বাস হলেও সেই পুলিশের ঘাড়ে দোষ চাপানো হত! আমরা তো রীতিমত নিয়ম করে বালির গাড়ি ধরছি। মামলাও করা হচ্ছে।”

যদিও মনটা খচখচ করছে অনেকেরই। সইফুলের আত্মীয়েরাই বলছেন, ‘‘কী জানি! একটু সচেতন, সতর্ক হলে হয়তো বিপর্যয় হতো না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bike accident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE