করোনার দাপটে কাঁপছে বিশ্ব। এই ‘অতিমারি’ থেকে কবে রেহাই মিলবে, তা নিয়েই এখন আশা-আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন নানা দেশের মানুষজন। এমন পরিস্থিতিতে বর্ধমানে ফিরে আসছে দেড়শো বছর আগের এক ‘মহামারি’র আলোচনা। ‘বর্ধমান জ্বর’ নামে পরিচিত সেই রোগ তখন প্রাণ কেড়েছিল বহু মানুষের। রোগীদের দেখভাল করার জন্য বর্ধমানে এসে থেকেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাসিন্দাদের অনেকের মুখে ফিরে আসছে সে সবের চর্চা।
বর্ধমানের বিশিষ্ট চিকিৎসক এস কে দাস বলছিলেন, ‘‘শুধু বর্ধমান নয়, তৎকালীন সময়ে দক্ষিণবঙ্গের একের পরে এক গ্রাম উজাড় হয়ে গিয়েছিল। বহু জনপদ হারিয়ে যায়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘১৮৭৪ সালে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট’ ওই মহামারিকে ‘বর্ধমান জ্বর’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যা আদতে ম্যালেরিয়া বলে মনে করা হয়। তবে কেউ কেউ ‘টাইফয়েড’ বা ‘কালাজ্বর’ বলেও মনে করেছিলেন।’’
বর্ধমানের ইতিহাস গবেষকদের দাবি, ‘বর্ধমান জ্বর’ নামকরণ নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। কী ভাবে এই রোগ বর্ধমানে এসেছিল, তা নিয়েও মতভেদ দেখা যায়। যা জানা যায়, বর্ধমান জেলায় এই জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ১৮৬২-৬৩ সালে। ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত জ্বর স্থায়ী হয়েছিল। ১৮৭১ থেকে ১৮৭৪ সাল, এই তিন বছরে বর্ধমান জেলায় ‘বর্ধমান জ্বরে’ কয়েক লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে নানা তথ্য-পরিসংখ্যান থেকে মনে করা হয়। এই ‘মহামারি’ আটকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইংরেজ সরকার এককালীন পাঁচ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে।
বর্ধমান থেকে প্রকাশিত ‘লোকভারতী’তে সঞ্জীব চক্রবর্তী একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘বর্ধমান জেলায় পূর্বস্থলীতে এই রোগ প্রথম দেখা দেয়। ১৮৬৭ সালে মেমারির ঘোষ গ্রামে, ১৮৬৯ সালে বর্ধমান শহরে সংক্রমণ শুরু হয়’। ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট’ থেকে জানা যায়, তৎকালীন বর্ধমান জেলার মুখ্য পরিদর্শক (স্বাস্থ্য) গোপালচন্দ্র রায় জানিয়েছিলেন, ১৮২৪ সালে পূর্ব বঙ্গের (বর্তমানে বাংলাদেশের) যশোরে ‘অজানা জ্বর’-এর উৎপত্তি হয়। ১৮৬৩ সালে ইংরেজ সরকার জ্বরের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের জন্য রাজা দিগম্বর মিত্রের নেতৃত্বে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। বর্ধমানের তৎকালীন সিভিল সার্জেন জন গে ফ্রেঞ্চ জানিয়েছিলেন, বর্ধমান জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ‘এনডেমিক সেন্টার’ খুলতে হয়েছিল। ১৮৯২ সালে ডাকঘরের মাধ্যমে কুইনাইন বিলি করা হয়েছিল।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র মারফত জানা যায়, অবিভক্ত বর্ধমান জেলায় ঢোকার আগে এই জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল ২৪ পরগনা, হুগলি, মেদিনীপুর জেলায়। বর্ধমান রাজ বংশ নিয়ে গবেষণা করা নীরদবরণ সরকার দাবি করেন, ‘‘বর্ধমান শহরের কাঞ্চননগরের জনপদ কার্যত শেষ হয়ে গিয়েছিল। রাজা মহতাবচাঁদ জেলায় অনেকগুলি স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুলেছিলেন। ইংরেজ সরকারকে নগদ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্যও করেছিলেন।’’
বিনা চিকিৎসায় রোগীরা মারা যাচ্ছেন, এই খবর পেয়ে বর্ধমানে পৌঁছন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। চিকিৎসক গঙ্গানারায়ণ মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে গোদা, কেশবগঞ্জ চটি-সহ নানা এলাকা ঘুরে পথ্য দিয়েছিলেন। বর্ধমানের ইতিহাস গবেষক সর্বজিৎ যশের কথায়, ‘‘কমলসায়রে একটি বাড়িতে উঠেছিলেন বিদ্যাসাগর। সেখানে ত্রাণ শিবিরও খুলেছিলেন। বিদ্যাসাগরের ভূমিকা দেখে ইংরেজ সরকার নড়েচড়ে বসেছিল। বাধ্য হয়েছিল চিকিৎসক ও পথ্য বাড়াতে।’’