Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বাড়া ভাতে ছাই পড়ে যখনতখন

বক্তারনগর, বাবুইশোল, পলাশবন, নতুন মদনপুর, চকরামবাটি, হরিশপুর, ধান্ডাডিহি ও রনাই এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাঁদের এই ভোগান্তি হচ্ছে বাতাসে উড়ে আসা কালো ছাইয়ের দৌলতে।

জল: ছাইয়ে ঢেকেছে বক্তারনগর গ্রামের জলাশয়। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ

জল: ছাইয়ে ঢেকেছে বক্তারনগর গ্রামের জলাশয়। ছবি: ওমপ্রকাশ সিংহ

নীলোৎপল রায়চৌধুরী
রানিগঞ্জ শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৭ ০৬:২১
Share: Save:

জুঁই ফুলের রং কালো!

কালো জুঁইয়ের এ কাহিনী রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ থেকে নয়, মিলেছে বাস্তবেই। পশ্চিম বর্ধমানের রানিগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকায়।

বক্তারনগর, বাবুইশোল, পলাশবন, নতুন মদনপুর, চকরামবাটি, হরিশপুর, ধান্ডাডিহি ও রনাই এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাঁদের এই ভোগান্তি হচ্ছে বাতাসে উড়ে আসা কালো ছাইয়ের দৌলতে। যে ছাইয়ের উৎস লাগোয়া একাধিক স্পঞ্জ আয়রন কারখানা। ছাইয়ের স্তর জমে কালো হয়ে যায় বলে তাঁরা বাড়ির বাইরে জামা-কাপড় মেলতে পারেন না। বাড়া ভাতে আক্ষরিক অর্থে যখনতখন ছাই পড়ে। পুকুরে প্রায় সব মাছ মরে গিয়েছে। পুকুরে স্নান করতে গেলে জলের উপরে কালো আস্তরণ সরিয়ে ডুব দিতে হয়। তাতে চর্মরোগ বা়ড়ছে। এলাকার সব বাড়ি, সব গাছের ফুল-পাতা ঝুল-কালি মাখা। তাদের রংটুকু চোখে পড়ে কেবল প্রবল বৃষ্টিতে ছাইয়ের আস্তরণ ধুয়ে গেলে। যদিও একটু পরেই আবার যে-কে সেই।

অভিযোগের তালিকা আরও দীর্ঘ। কালো ছাইয়ে ঢাকা ধানের খড় গবাদি পশু খেতে পারছে না। সে খড় খেয়ে গরু, ছাগলের মৃত্যুও হয়েছে। তা ছাড়া, এলাকায় শিশু ও বয়স্কেরা শ্বাসকষ্টজনিত নানা রোগে ভুগছেন। আসানসোল হাসপাতালের প্রাক্তন সুপার শ্যামল সান্যালের কথায়, ‘‘এর প্রধান কারণ ওই এলাকার বায়ুদূষণ।’’

স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী মঙ্গলপুর শিল্পতালুকের স্পঞ্জ আয়রন কারখানাগুলি। দূষণের বিরোধিতায় এক সময়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন এলাকাবাসী। তাঁদের অনেকেরই ধারণা ছিল, রাজ্যে সরকার বদলালে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু ‘পরিবর্তনের’ ছ’বছর পরেও অবস্থা একই রয়েছে ক্ষোভে এখন অনেকেই ভিটে ছেড়ে অন্যত্র সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।

স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০০০ সাল থেকে রানিগঞ্জের এই এলাকায় ধাপে ধাপে সাতটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানা তৈরি হয়। ধান্ডাডিহির অজয় পাত্র, বক্তারনগরের নির্মল পালদের অভিযোগ, ‘‘তার পর থেকেই আমাদের এলাকায় দেখা দেয় কালো ছাইয়ের উৎপাত।’’ তাঁরা জানাচ্ছেন, ২০০৩-এ তৎকালীন মৎস্যমন্ত্রী কিরণময় নন্দ বক্তারনগরে একটি মৎস্য সমবায়ের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের মাস তিনেক পরে দেখা যায়, পুকুরের প্রায় সব মাছ মরে গিয়েছে। পুকুরের জলে কালো ছাইয়ের আস্তরণ পড়ে গিয়েছে। যে মাছগুলি বেঁচে ছিল, সেগুলিও আকারে বাড়েনি।

শুধু মৎস্য সমবায় নয়, প্রভাব পড়েছে চাষবাসেও। চকরাবাটির কমলেশ সিংহ, বাবুইশোলের রাজু ঘাঁটিরা জানান, ১০ বছরেরও বেশি চাষাবাদ বন্ধ। তাঁদের কথায়, ‘‘কালো ছাই জমে গিয়েছে জমিতে। ওই ছাই সরানো অনেক খরচার ব্যাপার। তাই চাষবাসের পাটই তুলে দিতে হয়েছে।’’

২০০৪ সালে এই দূষণের বিরোধিতায় আন্দোলনে নামেন এলাকাবাসী। স্মারকলিপি জমা দিতে গেলে একটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার মালিকের সঙ্গে গ্রামবাসীদের ঝামেলা হয়। স্থানীয় তৃণমূল নেতা তথা বক্তারনগরের বাসিন্দা লুইচাঁদ সূত্রধরের দাবি, ওই ঘটনায় ন’জন গ্রামবাসী জেল খাটেন। লুইচাঁদবাবুর আক্ষেপ, “আমিও জেল খেটেছি। ভেবেছিলাম, রাজ্যে আমাদের সরকার এলে দূষণ ছড়ানো কারখানাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এত দিনেও কিছু না হওয়ায়, অনেকে এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।”

এক ধাপ এগিয়ে রানিগঞ্জের সিপিএম বিধায়ক রুনু দত্তের অভিযোগ, ‘‘কারখানার মালিকেরা খরচা বাঁচাতে দূষণরোধী যন্ত্র চালু রাখেন না। তাদের কাজে শাসক শিবিরের মদত রয়েছে।’’ অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূলের পশ্চিম বর্ধমান জেলা সভাপতি ভি শিবদাসন বলেন, ‘‘বামেদের আমলেই ওই কারখানাগুলো হয়েছে। ওদের মদতেই এরা বেড়েছে। আমাদের সরকার দূষণ আটকাতে যথেষ্ট সক্রিয়।’’ দূষণ ছড়ানোর অভিযোগ মানেননি স্পঞ্জ আয়রন কারখানা কর্তৃপক্ষও। তাদের সংগঠনের নেতা পবন মাউন্ডিয়ার কথায়, ‘‘আমরা বিধি মেনেই দূষণ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালাই।’’ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তরফে দাবি করা হয়েছে, ওই এলাকায় দূষণ নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত অভিযান নিয়মিত চালানো হয়। প্রয়োজনে জরিমানাও করা হয়।

এলাকাবাসী কিন্তু নিয়মিত সাদা জুঁইকে কালো হতে দেখছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Factories Ashes Black Flower
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE