সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একলা হয়ে পড়া প্রবীণদের শেষ বয়সের ভবিতব্য কী, প্রশ্ন তুলেছেন নাগরিকেরাই। প্রতীকী ছবি।
ছেলেমেয়ে থেকেও কেউ ‘বিনা চিকিৎসা’য় মারা গিয়েছেন। কারও আচমকা কয়েক দিন খবর মিলছে না। পরে তাঁর খবর মিলছে। অবশ্য তাঁর নয়, বলা ভাল তাঁর দেহের। সাম্প্রতিক সময়ে দুর্গাপুর শহর জুড়ে এ ভাবেই একের পর এক প্রবীণের মৃত্যুর ঘটনা সামনে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একলা হয়ে পড়া ওই প্রবীণদের শেষ বয়সের ভবিতব্য কী এমনই, প্রশ্ন তুলেছেন নাগরিকেরাই।
২০১৮-র জানুয়ারি। বিনা চিকিৎসায় এমএএমসি টাউনশিপের সুকান্তপল্লির ভাড়াবাড়িতে শয্যাশায়ী ছিলেন এমএএমসি কারখানার প্রাক্তন আধিকারিক স্মৃতিকণা ভট্টাচার্য। পাঁচ মাসের বাড়ি ভাড়া বকেয়া ছিল। বাড়ির মালিক গোবিন্দ দেবনাথ ও পড়শিরা তাঁর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু আচমকা ওই প্রাক্তন আধিকারিকের শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হয়। খবর পেয়ে তাঁকে মহকুমা হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেন পুরসভার ডেপুটি মেয়র অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়। স্মৃতিকণাদেবীর দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন স্বামী। প্রথম দিকে মেয়েরা খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু গোবিন্দবাবু দাবি করেছিলেন, মায়ের কথা জানাতে দুই মেয়েকে ফোন করা হলেও তাঁরা গোবিন্দবাবুকে চিনতেই অস্বীকার করেন। দিন কয়েকের মধ্যে মৃত্যু হয় স্মৃতিকণাদেবীর।
২০১৮-র ১২ মার্চ। ডিএসপি টাউনশিপের জয়দেব অ্যাভিনিউয়ের একটি কোয়ার্টারে দাদার সঙ্গে থাকতেন সেন্ট্রাল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন কর্মী, মানসিক ভারসাম্যহীন কৃষ্ণপ্রসাদ ভট্টাচার্য। ১২ মার্চ রাতে দাদার মৃত্যুর পরে শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করেন এলাকাবাসী। কিন্তু ওই ঘটনার পরেই সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েন কৃষ্ণপ্রসাদবাবু। স্থানীয় বাসিন্দারাই তাঁর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। নিয়মিত ঘর সাফও করতেন তাঁরা। অক্টোবরের শেষে তিনিও শয্যাশায়ী হন। কৃষ্ণপ্রসাদবাবুকে দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করায় পুলিশ। ১ নভেম্বর সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর।
এমন ঘটনার সাম্প্রতিকতম সংযোজন গত সোমবার। এমএএমসি কলোনির বি-২ এলাকায় নিজের কোয়ার্টার থেকেই উদ্ধার হয় ৭০ বছরের অশোক রায়ের দেহ। দু’-তিন ধরে তাঁর দেখা মিলছিল না। শেষমেশ কোয়ার্টারের দরজায় দু’দিনের খবরের কাগজ পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয় পড়শিদের। তাঁরা দেখেন, রান্নাঘরে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে বৃদ্ধের দেহ। এমএএমসি-র প্রাক্তন কর্মী বিপত্নীক অশোকবাবু বেহালায় আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতেন। দু’-তিন মাস অন্তর এক বার দুর্গাপুরে কোয়ার্টারে এসে দিন কয়েক কাটাতেন।
তবে শুধু একাকী অবস্থাতেই এমন দুর্ভোগ হচ্ছে, তা নয়। মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে ডিএসপি টাউনশিপের বিদ্যাপতি রোডে কোয়ার্টারে থাকতেন বৃদ্ধা দেবযানী বার্নওয়াল। ২০১৭-র ৩১ অক্টোবর সকালে বন্ধ ঘরের জানলা দিয়ে পড়শিদের কাছে খাবার চান তিনি। পড়শিরা দেখেন, বাড়ি বাইরে থেকে তালাবন্ধ। জানা যায়, প্রায় সপ্তাহ খানেক আগে মেয়ে-জামাই তাঁকে তালাবন্ধ রেখে বেরিয়ে গিয়েছেন। সে দিন দুপুরে মেয়ে-জামাই ফিরতেই স্থানীয়দের একাংশ তাঁদের উপরে চড়াও হন। তাঁরা যদিও দাবি করেন, মাঝে একদিন এসে দেখে গিয়েছেন। ঘরে খাবার মজুত করেই বেরিয়েছিলেন। এমন ঘটনা যাতে ফের না ঘটে, মেয়ে-জামাইয়ের কাছে মুচলেকা লিখিয়ে নেয় পুলিশ।
এই পরিস্থিতিতে শহরের প্রবীণেরাও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। সিটি সেন্টারের অসীম চট্টোপাধ্যায়, স্বরাজ মণ্ডলেরা বলেন, ‘‘আমরা ভাল আছি। কিন্তু আরও অনেক প্রবীণই ভাল নেই। সকলের কাছে আর্জি, এই একা শহরে, প্রবীণদের জন্যও থাক একটু সময়। কারণ, ওই প্রবীণ নাগরিকদের কথা জেনে এখন দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছা়ড়া আর কিছুই করার থাকে না আমাদের।’’
কিন্তু সত্যিই কি কিছুই করার নেই পুরসভা, প্রশাসনের, প্রশ্ন উঠেছে সেটাও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy