Advertisement
E-Paper

লড়াই ছাড়ব না, হেসে বলে প্রিয়ারা

কখনও পাঁচ জনের সংসারে মাটির এক কামরার ঘরে গাদাগাদি করে পড়া, কখনও শিক্ষকদের কাছে চেয়েচিন্তে বই জোগাড় করা— জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষাটা এভাবেই দিয়েছিল ওরা।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৬ ০১:২৯
ফল বেরনোর পরে অঙ্কিতা, প্রিয়া, সুদীপ (বাঁ দিক থেকে)। নিজস্ব চিত্র।

ফল বেরনোর পরে অঙ্কিতা, প্রিয়া, সুদীপ (বাঁ দিক থেকে)। নিজস্ব চিত্র।

ছোট থেকেই জীবনযুদ্ধের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ওদের বড় হওয়া।

কখনও পাঁচ জনের সংসারে মাটির এক কামরার ঘরে গাদাগাদি করে পড়া, কখনও শিক্ষকদের কাছে চেয়েচিন্তে বই জোগাড় করা— জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষাটা এভাবেই দিয়েছিল ওরা। পরিশ্রমের মান রেখেছে সাফল্য। অভাব পেরিয়ে এক হয়েছে যোজন দূরের ভাতার, মঙ্গলকোট। জুটি বেঁধেছে দুর্গাপুর, বর্ধমান।

দু’পয়সা বাঁচাতে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাড়িতে আলো জ্বালানো প্রায় নিষেধ ছিল। ল্যাম্পের আলোতে পড়েই ৯২ শতাংশ নম্বর ছিনিয়ে এনেছে মঙ্গলকোটের যবগ্রাম মহারানি কাশীশ্বরী ইনস্টিটিউশনের ছাত্রী প্রিয়া গড়াই। মাধ্যমিকে সে পেয়েছে ৬৪৬। তবে মেয়ের সাফল্যে খুশির থেকেও চিন্তা বেশি বাবার। মঙ্গলকোটের প্রান্তিক চাষি তপন গড়াইয়ের আক্ষেপ, ‘‘ধানের দাম মেলে না। জলের অভাবে সব জমিতে চাষও করতে পারিনি। কয়েক বছর ধরে কী ভাবে সংসার চালিয়েছি আর মেয়েদের পড়াশুনো করাতে পেরেছি, তা একমাত্র ভগবান জানেন।” বাবার চাপ কমিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বাড়ি ছেড়ে এ বার হুগলির মামারবাড়িতে থাকবে প্রিয়া। তার কথায়, ‘‘বাবা আর টানতে পারছেন না। বোনও বড় হচ্ছে। তাই মামারবাড়ি থেকেই পড়াশুনো করব বলে ঠিক করেছি।” তবে পুরনো স্কুলের শিক্ষকদের ও গৃহশিক্ষকের সাহায্য না হলে এতটা পথ আসতে পারত না বলেও জানিয়েছে সে।

কম লড়াই দেয়নি অঙ্কিতা ধীবরও। বর্ধমানের নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়ের এই ছাত্রী ৬৭০ পেয়ে সকলের নজর কেড়ছে। তাঁর বাবা দিলীপবাবু ফাগুপুরের এক সোনার দোকানের কর্মচারী। মা চন্দনাদেবী গৃহবধূ। মা-বাবাই অঙ্কিতার প্রেরণা। অঙ্কিতা বলে, ‘‘মা-বাবা যেভাবে লড়াই করে সংসার চালায়, আমিও সেভাবে লড়েই জীবনটা গড়ে নেব।’’ মেয়েকে নিয়ে গর্বিত দিলীপবাবু জানান, অঙ্কিতা বড় হয়ে ডাক্তার হতে চায়। টাকা জোগানোটাই চ্যালেঞ্জ তাঁর কাছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রিয় অঙ্কিতা অবশ্য ইচ্ছেয় দৃঢ়। তাঁর স্কুলের শিক্ষিকা স্বগতা মণ্ডল বলেন, ‘‘পঞ্চ শ্রেণি থেকেই অঙ্কিতা ক্লাসে প্রথম হয়। আমাদের অনেক শিক্ষিকাই বিনা পয়সায় ওকে পড়ান।’’ চন্দানাদেবী বলেন, ‘‘ভাতের পাতে মাংস পেলে খুব খুশি হয় মেয়েটা। ন’মাসে-ছ’মাসে এক বার খুশি ফোটাতে পারি ওর মুখে। মেয়ে কিন্তু আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে।’’ মঙ্গলবার অঙ্কিতাকে সংবর্ধনা দেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি দেবু টুডু। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ার বইপত্র সমেত যাবতীয় খরচ দেবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

ডাক্তার হতে চায় দুর্গাপুরের গোপালমাঠ হাইস্কুলের ছাত্র সুদীপ চট্টোপাধ্যায়ও। এ বার মাধ্যমিকে ৬৬২ পেয়েছে সে। তার বাবা সোমনাথবাবু অন্ডালের ডিভিসি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঠিকা শ্রমিকের কাজ করেন। সবদিন অবশ্য কাজ জোটে না। কাজ না থাকলে আয়ও বন্ধ। তাতেও কোনওরকমে বাড়ি ভাড়ার খরচ কুলিয়ে সংসার চালান তিনি। সুদীপের মা শিবানীদেবী জানান, বড় ছেলে সন্দীপ শারীরিক প্রতিবন্ধী। সুদীপকে ঘিরেই আশার আলো দেখছেন তাঁরা। সুদীপ জানায়, অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া থেকে বইপত্র কিনে দেওয়া, শিক্ষকেরা সাধ্যমতো করেছেন। তা না হলে এতটা এগোনো যেত না। স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবাশিস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এত প্রতিকূলতার মধ্যেও স্কুলের সেরা হয়েছে সুদীপ। সহপাঠীদের কাছে ও রীতিমতো নজির।’’ ছেলেকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের ফাঁকেই সোমনাথবাবুর আর্জি, ‘‘ওর পড়াশোনার জন্য কেউ যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তাহলে উপকৃত হব।’’

একই আর্জি শেখ রাজুর বাবা আমাদ আলিরও। রোদে-বৃষ্টিতে পোড়া খড়ের চালের বাড়িতে একটাই ঘর। সেখানেই দাদা-ভাইয়ের সঙ্গে বড় হয়েছে রাজু। পাঁচ জনের সংসারে গাদাগাদি করেই ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছে ভাতারের বামসোর উচ্চবিদ্যালয়ের ওই ছাত্র। বাবা লোহা কারখানার ঠিকাদারের কাছে দিনমজুরের কাজ করেন। হাঁসের ডিম, ছাগল বিক্রি করে কিছুটা রোজগার করেন মা। দু’জন গৃহশিক্ষকের সঙ্গে দাদা কাদের আলিও সবসময় সাহায্য করত তাকে। রাজুর কথায়, ‘‘৬৬৫ পেয়েছি। উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ব। খরচ তোলার জন্য আমাকেই এ বার কিছু একটা করতে হবে।”

Madhyamik
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy