Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
পুলিশ ফাইল থেকে

সাক্ষ্য দেয়নি কেউ, খারিজ খুনের মামলা

হাঁটা পথের মুখে প্রথমে একটা বাঁক। সেখানে বাঁধানো বটগাছের তলায় সবে সাইকেল থেকে নেমেছেন বছর সাতচল্লিশের কর্মী। আচমকা উল্টো দিক থেকে ছুটে এল এলোপাথাড়ি গুলি। ঘোলাটে চোখে বাড়ির দিকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না।

সুশান্ত বণিক
বার্নপুর শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৬ ০১:৩৮
Share: Save:

২০১১ সালের ৫ জুলাই বার্নপুরের নরসিংহবাঁধে খুন সিপিএম নেতা তথা ইস্কো কর্মী নির্গুণ দুবে। রাতে বাড়ি ফেরার সময়ে দোরগোড়ায় গুলিতে খুন হন তিনি। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এক জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সরকারপক্ষ কোনও সাক্ষী হাজির করতে না পারায় মামলা খারিজ।

মূল রাস্তা থেকে বাড়ি হাঁটা পথে মিটার পঞ্চাশ। সব্জি ভর্তি ব্যাগ হাতে বাড়ির দিকে এগোচ্ছিলেন ইস্কো কর্মী।

হাঁটা পথের মুখে প্রথমে একটা বাঁক। সেখানে বাঁধানো বটগাছের তলায় সবে সাইকেল থেকে নেমেছেন বছর সাতচল্লিশের কর্মী। আচমকা উল্টো দিক থেকে ছুটে এল এলোপাথাড়ি গুলি। ঘোলাটে চোখে বাড়ির দিকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। ধুলো ভরা রাস্তায় আছড়ে পড়ল শরীরটা। ব্যাগ থেকে ছড়িয়ে সেই রাস্তাতেই গড়াগড়ি খেল আলু, পটল, ঝিঙে।

২০১১ সালের ৫ জুলাই ঘড়িতে তখন রাত প্রায় সাড়ে ৯টা। বার্নপুরের নরসিংহবাঁধে নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হয়ে গিয়েছেন ইস্কোর কর্মী তথা সিপিএম নেতা নির্গুণ দুবে, এই খবর ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। তার কিছু দিন আগেই রাজ্য-রাজনীতিতে পালাবদল হয়েছে। ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। তার পরে আসানসোল শিল্পাঞ্চলে এটিই ছিল প্রথম কোনও রাজনৈতিক নেতা খুনের ঘটনা। সিপিএম নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে জানা যায়, সে দিন দলের পুরানহাটের কার্যালয় থেকে বাড়ি ফিরছিলেন নির্গুণবাবু। মাঝে কোথাও একটু দাঁড়িয়ে বাজার করেন। কিন্তু আর বাড়ি ফেরা হয়নি।

প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানিয়েছিল, মোটরবাইকে চড়ে এসে খুব কাছ থেকে গুলি করে আততায়ী। তার পরে দ্রুত এলাকা ছেড়ে পালায়। ব্যক্তিগত কোনও আক্রোশের জেরেই এই খুন বলে মনে করেছিল পুলিশ।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নরসিংহবাঁধ এলাকায় নির্গুণবাবু প্রতিবাদী চরিত্র হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। নানা অসামাজিক কাজকর্মের প্রতিবাদ করতেন। মদ-জুয়ার ঠেক বন্ধের জন্য রাস্তায় নেমেছিলেন। এলাকার মানুষকে নিয়ে দোষীদের গ্রেফতারের দাবিতে থানায় বিক্ষোভ করতেন। কয়েক জনকে জেলেও পাঠিয়েছিলেন। ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ, এর জন্য অনেক বার তাঁকে দুষ্কৃতীদের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু তিনি দমে যাননি।

এই খুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে ওঠে বার্নপুর। বিক্ষোভ, বন্‌ধ-অবরোধে অশান্ত হয় শিল্পাঞ্চল। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এক জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। অভিযুক্ত তিন মাস জেল-হাজতে ছিল। পরে জামিনে ছাড়া পায়। কিন্তু আদালতে শুনানিতে কোনও সাক্ষীকে হাজির করতে পারেননি সরকার পক্ষের আইনজীবী। ফলে, মামলা খারিজ হয়ে যায়। নিহতের পরিজনেরা তার পর থেকে এখনও ফের তদন্ত বা মামলা চালুর আর্জি জানাননি। ফলে, কে বা কারা কী কারণে নির্গুণবাবুকে খুন করে গেল, এখনও অজানাই রয়ে গিয়েছে।

নির্গুণবাবুর স্ত্রী ললিতা দেবী বলেন, ‘‘সে দিন আমার জ্বর হয়েছিল। রাত বাড়ছে দেখে বারবার ওঁর মোবাইলে ফোন করছিলাম। কিন্তু ফোন না ধরায় মনে কু ডাকতে শুরু করে।’’ তাঁর আক্ষেপ, খুনিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ সাক্ষীর অভাবে মামলাই খারিজ হয়ে গেল। সাক্ষী পাওয়া গেল না কেন? নির্গুণবাবুর বড় ছেলে অভীক দুবে অভিযোগ করেন, ‘‘কথা বলে জেনেছি, পাড়ার অনেকেই খুনের ঘটনা দেখেছেন। কিন্তু দুষ্কৃতীরা প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছে, কেউ সাক্ষ্য দিলে বাবার মতো হাল করবে। তাই ভয়ে কেউ সাক্ষ্যই দিলেন না।’’ ঘটনার কিছু দিন পরে তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধীর সঙ্গে দেখা করে নিরাপত্তার ব্যবস্থার জন্য আর্জি জানিয়েছিলেন ললিতাদেবী। তাঁর দাবি, আশ্বাস মিলেছিল, কিন্তু পরে আর তা হয়নি। বিচার আদৌ আর মিলবে কি না, সে নিয়েই এখন সংশয়ে নির্গুণবাবুর পরিবার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

bardwan police file
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE