নাগরিক কবিয়াল গান বেঁধেছিলেন, ‘সারা দিন ধরে টো টো কোম্পানি চালাল শহর জুড়ে...।’ এই কোম্পানির সূত্র বোধহয়, উঠতি বয়সের বাঙালির ঠেক থেকেই পাওয়া। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ফিকে হয়েছে চিলেকোঠা আর খালের ধারের আড্ডাগুলো। কিন্তু দুর্গাপুরের নবীন প্রজন্ম জানায়, আড্ডা একই আছে। তবে তার স্থানবদল হয়েছে। এখন আড্ডা চলে ডিজিটাল-ঠেকে।
ইংরেজি অনার্সের ছাত্র সৌম্য রায়। বসেছিলেন, জাতীয় সড়কের ধারে একটি শপিং মলের সিঁড়িতে। প্রবীণেরা প্রায়ই আক্ষেপ করেন, এখনকার ছেলেমেয়েরা আড্ডা জমাতে পারেন না। প্রসঙ্গ উঠতেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন সৌম্য। বললেন, ‘‘কেন আড্ডা দেব না? তবে সাবেক আড্ডার ধারণাটা বদলেছে। কলেজ, টিউশন, এ সব সামলে ক্লাব বা মাঠে যাওয়ার সময় কই। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা চলতেই থাকে।’’
আরও কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ডিজিটাল সেই পৃথিবীতেও আড্ডার ঠেকের নানা ভাগ রয়েছে। কয়েক জন জানান, ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে অনেক রকম ‘গ্রুপ’ রয়েছে। রয়েছে, স্কুল, কলেজের প্রাক্তনীদের গ্রুপ। এমনকি, এক সময়ের ফেলে আসা খেলার মাঠের সঙ্গীসাথীদের গ্রুপও। সেখানেই চলে আড্ডা। সাম্প্রতিক নানা প্রসঙ্গ, সামাজিক নানা বিষয় নিয়ে দেদার মজার কার্টুন শেয়ার, সবই চলে সেখানে।
মৌমিতা বসু। এমবিএ পাশ মৌমিতা বেসরকারি সংস্থার কর্মী। তিনি জানান, বছরে মাত্র কয়েকটা দিন বন্ধুরা সবাই এক জায়গায় হন। বাকি বছরভর যোগাযোগ, দেখা হলে কী কী পরিকল্পনা, সবই সারা হয় ওই ডিজিটাল-ঠেকেই। তাঁর কথায়, ‘‘দুর্গাপুজোর মতো কোনও বড় উৎসবে সবার সঙ্গে দেখা হয়। সারা সন্ধ্যা আড্ডা মেরে, রেস্তরাঁয় গিয়ে একসঙ্গে চলে খাওয়া-দাওয়া। বছরের বাকি দিনগুলিতে সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত।’’
আড্ডার সঙ্গে বাঙালির সৃজনশীলনতার যোগ নিয়ে নানা গল্প রয়েছে। যেমন, কলকাতায় ১১৩/২ হাজরা রোডের ধারে ‘প্যারাডাইস ক্যাফে’। সেই ঠেকে আড্ডা জমাতেন তখনকার যুবক মৃণাল সেন, ঋত্বিককুমার ঘটকেরা। চলে কবিতা, সিনেমা নিয়ে দেদার আড্ডা। সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘লালবাড়ি’র আড্ডা, যার টানে ধর্মেন্দ্রর সঙ্গেও দেখা করতে যাননি আশুতোষবাবু। এ ছাড়াও সুকুমার রায়ের ‘মণ্ডা’ ক্লাব, সত্যজিৎ রায়ের রবিবারের বাড়ির আড্ডা, কলকাতার কলেজ স্ট্রিকে প্রকাশক-সাহিত্যিকদের আড্ডা রীতিমতো বিখ্যাত ছিল। তা থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য-সিনেমাও তৈরি হয়েছে।
প্রবীণদের আক্ষেপ, এমন মননশীল আড্ডা আজ আর কই। কিন্তু দুর্গাপুরের নবীন প্রজন্ম কিন্তু এ সব আক্ষেপকে পাত্তা দিতে নারাজ। কলেজ পড়ুয়া অভিনব নাথের কথায়, ‘‘কলেজের দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ হোক বা নবীন বরণের অনুষ্ঠান, সব কিছুর পরিকল্পনা কিন্তু সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটেই হচ্ছে।’’ শুধু তাই নয়, কেরলের বন্যার মতো বিপর্যয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পরিকল্পনাও ঠিক হচ্ছে এমন ঠেকেই।
ডিজিটাল-আড্ডার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের কথা জানান অভিনব, মৌমিতারা। তাঁরা জানান, নিছক আড্ডায় অনেক সময়েই ‘আগল’ রেখে কথাবার্তা চলে। ডিজিটাল-ঠেকে সে দায় খানিক কম। তাতে বন্ধুকে চেনাও যায় অন্য আঙ্গিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy