Advertisement
E-Paper

ওয়ার্ডে ফুটছে চা, স্যালাইন হাতে ‘মাসি’রা

ভেজা রাস্তা, সিঁড়ি, হাসপাতালের বারান্দা। ইতিউতি মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছেন অনেকে। ঘুমচোখে নাছো়ড় মশার কামড় থেকে বাঁচতে হাত-পা নাড়াচ্ছেন রোগীর আত্মীয়েরা।

সৌমেন দত্ত

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৬ ০০:০৮
বাঁ দিকে, বর্ধমান মেডিক্যালে মহিলা ওয়ার্ডে বসে পুরুষেরা। ডান দিকে, স্যালাইন দিচ্ছেন আয়া। —নিজস্ব চিত্র।

বাঁ দিকে, বর্ধমান মেডিক্যালে মহিলা ওয়ার্ডে বসে পুরুষেরা। ডান দিকে, স্যালাইন দিচ্ছেন আয়া। —নিজস্ব চিত্র।

ভেজা রাস্তা, সিঁড়ি, হাসপাতালের বারান্দা। ইতিউতি মুড়ি দিয়ে শুয়ে রয়েছেন অনেকে। ঘুমচোখে নাছো়ড় মশার কামড় থেকে বাঁচতে হাত-পা নাড়াচ্ছেন রোগীর আত্মীয়েরা। তাঁদের মধ্যেই বসেছিলেন বোলপুরের বাহিরি থেকে বুকে ব্যথা নিয়ে ভর্তি এক রোগীর ভাইঝি চিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্লাস্টিকের চাদরে গুটিসুটি মেরে বসে তিনি বললেন, ‘‘অনাময় হাসপাতালে মহিলাদের থাকার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা উচিত।’’

হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, পিছন দিকে রোগীর পরিজনেদের থাকার একটা ব্যবস্থা আছে বটে, কিন্তু সেখানে পুরুষ ভর্তি। অগত্যা চিত্রাদেবীর মতো অনেকেরই ঠাঁই বাইরের বারান্দায়।

দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে উল্লাস মোড় লাগোয়া অনাময় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে রাতে বাইরে থেকে কারও ঢোকার অনুমতি নেই। তবে নির্দেশ মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য নেই নিরাপত্তারক্ষীও।

সেখান থেকে পাড়ি বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। রাধারানি ওয়ার্ডে এক নিরাপত্তারক্ষী আছেন বটে, তিনি কিন্তু গল্প করতেই ব্যস্ত। সোজা ঢুকে চারটি ব্লক ঘুরেও বোঝা গেল না, কোনটা পুরুষ ওয়ার্ড কোনটা মহিলা। সব জায়গায় সবার প্রবেশ অবাধ। পুরুষ-ব্লকে নিশ্চিন্তে ঘুম দিচ্ছেন মহিলারা। ওয়ার্ডের ভিতরই জটলা করে কয়েকজন মহিলা মনের আনন্দে খোসগল্প জুড়েছেন। ‘‘আপনারা পুরুষ ওয়ার্ডে কী করছেন?’’—সপাট উত্তর, ‘‘আমাদের রোগী আছে। তাই রয়েছি।’’ অন্য ওয়ার্ডে পুরুষদের গলাতেও এক সুর। ওয়ার্ডের সামনে বসার জায়গা দখল করে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিব্যি চলছে চায়ের দোকানও।

চোখ গেল, ওয়ার্ডের শেষ প্রান্তে। বেশ কয়েকজন মহিলা হাতে ওষুধ ভরা সিরিঞ্জ নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। একটার পর একটা শয্যায় গিয়ে রোগীদের স্যালাইনের পরিমান ঠিক করছেন, স্যালাইন দিচ্ছেনও। এরা কে, জিজ্ঞাস করায় মুখ খুললেন সিউড়ির হামিনা বিবি, কুসুমগ্রামের জয়নাব সাহানারা। তাঁদের অভিযোগ, “নার্সরা সিরিঞ্জ ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছেন ওই মাসিদের। তাঁরাই যা করার করেন। নার্সরা রাতে আসেন মর্জি মাফিক। আমরাও সাহায্য করি।’’ কিন্তু এটা তো তাঁদের কাজ না? উড়ে এলে মুখ ঝামটা, ‘‘আমরা না থাকলে রোগীদের কে দেখবে শুনি?”

এ বার জরুরি বিভাগ। সিঁড়ির মুখে কয়েকজন শুয়ে রয়েছেন। ট্রলির অভাবে এক মহিলা রোগীকে কোলে করে নিয়ে এলেন পরিজনেরা। চার তলা পর্যন্ত অবাধে ঘুরে দেখা গেল, রোগী ও তাঁর স্বজনেরা এক সঙ্গে মাটিতে শুয়ে রয়েছেন। পাশের অনুসন্ধান কেন্দ্রের ঘরে পুলিশ-ক্যাম্পে এক এএসআই ও দু’জন সিভিক ভলেন্টিয়ার লুডো খেলতে ব্যস্ত। তারমধ্যেই পায়ে প্লাস্টার থাকা এক রোগীকে অ্যাম্বুল্যান্সের স্ট্রেচারে করে নিয়ে এলেন চার জন। বাঘার ১ পঞ্চায়েতের বাসিন্দা রণজিৎ রানা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, “ঘন্টা খানেক ধরে চেষ্টা করেও ট্রলি পেলাম না। হাসপাতালে কোনও কর্মী আছে বলেই তো মনে হচ্ছে না!’’

তাঁদের দেখে হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন এক যুবক। গাছতলায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ফিসফাসের পরে বললেন ‘‘কোনও চিন্তা নেই। সব ব্যবস্থা করে দেব। রাত বিরেতের ব্যাপার, বুঝতেই পারছেন। একটু বেশি লাগবে আর কী!”

কিছু দিন আগেই এই হাসপাতালের এক কর্মীর বিরুদ্ধে এমআরআই করে দেওয়ার নাম করে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। কর্তৃপক্ষ খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন, ওই রোগীর স্বাস্থ্য বীমার কার্ড ছিল। রাতে আসা রোগীদের ভুল বুঝিয়ে টাকা নিতেন তিনি। বোঝা গেল, দেওয়ালে যতই ‘দালাল থেকে সাবধান’ লেখা থাক, রাতের হাসপাতালে যে কোনও কর্মীই দালাল হয়ে যান!

কান্নার শব্দে চিন্তার সুতো ছেঁড়ে। বীরভূমের নানুরের বাসিন্দা সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘বিয়ের সাত বছর পরে কয়েক দিন আগে এক সঙ্গে ছেলে-মেয়ে হয়। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেও এক জনের জীবনও রক্ষা করতে পারলেন না। বউকে এখনও জানাতে পারিনি।”

জীবনের কত রঙই না ধরা দেয় রাতের হাসপাতালে।

(চলবে)

Hospital Mismanagement
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy