E-Paper

শিল্প-চাহিদা মাথায় রেখে ‘সিন্ডিকেট’

একাধিক খনি বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, বেসরকারি আমলে কয়লা সংস্থার মালিকেরা রানিগঞ্জ, আসানসোল-সহ নানা জায়গায় ছোট, বড় কুয়ো খাদ বানিয়ে কয়লা তুলতেন।

সুশান্ত বণিক, সুব্রত সীট

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:৪৫
প্রকাশ্যে এসেছে তাঁদের ‘সিন্ডিকেটের’ কথা।

প্রকাশ্যে এসেছে তাঁদের ‘সিন্ডিকেটের’ কথা।

গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া রাজেশ ওরফে রাজু ঝা হোক বা সাম্প্রতিক সময়ের অনুপ মাজি ওরফে লালা— বেআইনি কয়লা-কারবারের তদন্তের সূত্রেই বার বার সামনে এসেছে তাঁদের ‘সিন্ডিকেটের’ কথা। কয়লা-কারবারের চার্জশিটেও এই সিন্ডিকেটের কথা উল্লেখ করেছে সিবিআই। কিন্তু কয়লা-সিন্ডিকেট কেন তৈরি হল? কয়লা-ক্ষেত্রের সঙ্গে পরিচিতদের ধারণা, এর মূল কারণ, বাজারের চাহিদা এবং পশ্চিম বর্ধমানে শিল্পায়ন।

একাধিক খনি বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, বেসরকারি আমলে কয়লা সংস্থার মালিকেরা রানিগঞ্জ, আসানসোল-সহ নানা জায়গায় ছোট, বড় কুয়ো খাদ বানিয়ে কয়লা তুলতেন। তাঁরা মনে করতেন, ‘যত বেশি কুয়ো, তত বেশি কয়লা’ (‘মোর হোল, মোর কোল’)। কিছুটা খননের পরে কয়লা তোলা যখন লাভজনক থাকত না, তখন এই কুয়োগুলিকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রাখতেন মালিকেরা। কয়লা-শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের পরে, কয়লা চোরেদের নজর পড়ে এই পরিত্যক্ত কুয়ো খাদগুলির দিকে। পাশাপাশি, নতুন বেআইনি কুয়ো খাদও তৈরি করে তারা। আশির দশকের শেষ পর্যন্ত এ ভাবেই বিক্ষিপ্ত ভাবে ভূগর্ভের সঞ্চিত কয়লা অবৈধ ভাবে কেটে তুলে তা ছোট রিফ্র্যাক্ট্রি শিল্পে, ইটভাটা, দোকান ও গৃহস্থালির কাজে সরবরাহ করা হত। অভিযোগ, টাকার ‘ভাগ’ পেতেন শুধু স্থানীয় নেতা বা পুলিশকর্মীদের একাংশ।

কিন্তু নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে শিল্পাঞ্চলের অর্থনীতির চিত্র বদলাতে থাকে। রাজ্যের নতুন শিল্পনীতির হাত ধরে আসানসোল, দুর্গাপুর, রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া প্রভৃতি এলাকায় শিল্পতালুক তৈরির তোড়জোড় শুরু হয়। দুর্গাপুর, রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া, নিতুড়িয়া, কল্যাণেশ্বরী, পারবেলিয়া-সহ বিভিন্ন এলাকায় স্পঞ্জ আয়রন, রিফ্র্যাক্ট্রি শিল্পের কারখানা ও লালইট তৈরির চিমনি ভাটা, কয়লা অনুসারী নানা শিল্প ও বেসরকারি কারখানায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পিগ আয়রন, ইনগট, ফেরো অ্যালয়, সিমেন্টের কারখানা তৈরি হয়। সঙ্গত দিয়ে জোয়ার আসে শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, হোটেল, রেস্তরাঁ, নির্মাণ শিল্পেও।

পাল্লা দিয়ে বাড়ে কাঁচামাল কয়লার চাহিদা। অভিযোগ, ঠিক এই সুযোগটাই প্রথমে সরযূ উপাধ্যায়, পরে রাজু ঝা এবং আরও পরে, লালারা লুফে নিয়েছিলেন। প্রয়োজন পড়ে আরও বেশি পরিমাণে চুরি করা কয়লা এবং তা সুষ্ঠু ভাবে পরিবহণ করার। প্রয়োজন ও চাহিদা মেটাতেই সিন্ডিকেটের আত্মপ্রকাশ বলে পর্যবেক্ষণ খনিকর্তাদের একাংশের। এই সিন্ডিকেটে ধীরে ধীরে নাম জড়ায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সরকারি আধিকারিক, পুলিশ ও ‘প্রভাবশালীদের’, জানা যাচ্ছে সিবিআইয়ের তদন্তের সূত্রেই। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ভাবে টাকাও পৌঁছে দেওয়া হয়েছে নানা জায়গায়। আর চুরি করা কয়লা জেলা, রাজ্য ও ভিন্-রাজ্যের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।

বিষয়টির সমর্থন মেলে সিবিআইয়ের তদন্তেও। সিবিআই আদালতে জানিয়েছিল, কয়লা সহায়ক অনুসারী কারখানাগুলিতে চুরি করা কয়লা সরবরাহ করা হয়েছে। কয়লা চুরির চার্জশিটেও এমন ১৫টি শিল্প সংস্থার কর্ণধারদের নাম উল্লেখ করেছে সিবিআই।

কিন্তু তদন্তের ভয় আছে জেনেও কেন চুরি করা কয়লা ‘কিনত’ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি? ইসিএলের বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, তাঁরা দু’ভাবে কয়লা সরবরাহ করেন। প্রথমত, শিল্প সংস্থার প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ ‘কোটা’ ধার্য করা হয় (‘লিঙ্কেজ’)। সংস্থাগুলি কোনও ভাবে যাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কয়লা মজুত করে কালোবাজারি করতে না পারে, তাই এই ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত, খোলা বাজারে ই-নিলামের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কয়লা কিনতে পারে সংস্থাগুলি। কিন্তু ইসিএলের তুলনায় অবৈধ কয়লার দর প্রায় অর্ধেক। পাশাপাশি, চুরি করা কয়লা মজুত করতেও অসুবিধা নেই।

এ দিকে, এলাকার শিল্পক্ষেত্রের একাংশের সঙ্গে সরাসরি কয়লার বেআইনি কারবারের যোগাযোগ রয়েছে বলে অনুমান শিল্প-বিশেষজ্ঞদের একাংশের। তাঁরা জানাচ্ছেন, কয়লা কারবারে কিছুটা লাগাম পড়তেই ভিড় কমে যায় শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্সে, রেস্তরাঁয়। আগে যেখানে ভূমি পুজোর সময়েই অধিকাংশ ফ্ল্যাট বুকিং হয়ে যেত, সেখানে বহু তৈরি ফ্ল্যাট ক্রেতার অভাবে পড়ে থাকতে শুরু করে দুর্গাপুর, আসানসোলের মতো শহরগুলিতে। তা ছাড়া, দুর্গাপুর পুরসভার হিসাবে, অন্তত ৫২টি লগ্নি সংস্থার অফিস ছিল সিটি সেন্টার এলাকায়। সেগুলির বেশির ভাগেরই ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। শহরের বাড়িভাড়ার হার নেমে যায় এক ধাক্কায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিল্পোদ্যোগীর কথায়, “কয়লার চোরা কারবারে লাগাম এবং সরকারি নীতির ফলে, স্থানীয় বাজারে মন্দা। এই পরিস্থিতিতে বহু ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নামমাত্র উৎপাদন বজায় রেখে কার্যত খাতায়-কলমে কারখানা চালু রেখেছেন কেউ-কেউ।” (শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Raju Jha Asansol

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy