বাঁকা শুধু নদী নয়। ইতিহাসের একটি খণ্ড। সেই নদী বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় মানুষের মতামত চাইছে বর্ধমান পুরসভা। রবিবার বর্ধমান টাউন হলে নাগরিক সভা ডেকে বাঁকা বাঁচানোর নানা পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হয়।
এক সময়ে বর্ধমানের রাজাদের পূর্বপুরুষেরা নৌকায় যাতায়াত করতেন এই নদীপথে। বাঁকা ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম। এখন সেই নদী অস্তিত্বরক্ষার লড়াই লড়ছে। সে লড়াইয়ে বর্ধমান শহরের বাসিন্দাদের যুক্ত করতে চায় বর্ধমান পুরসভা। নদীরক্ষায় তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে পরিকল্পনা করে এগোতে চায় পুরসভা।
এ দিন বিজ্ঞান মঞ্চের জেলা সভাপতি তুষারকান্তি বটব্যাল অভিযোগ করেন, বর্ধমান শহরের অনেক জায়গায় অবৈধ দখলের ঠেলায় বাঁকা নালায় পরিণত হয়েছে। নদীর জলকে সারা বছর প্রবাহিত করার জন্য যেমন ব্যবস্থা নিতে হবে, তেমনি নদীকে দূষণ মুক্ত করে মাছ চাষ, পরিবহণ ব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, দাবি তাঁর। এই উদ্যোগে সমাজের সব স্তরের মানুষকে পাশে দাঁড়ানোর ডাক দেওয়া হয়। বর্ধমানের পুরপ্রধান পরেশ সরকারও বলেন, ‘‘বাঁকার পাড় দখল করে বেআইনি নির্মাণ হয়েই চলেছে। বর্ধমান শহরের বাসিন্দাদের বড় অংশ বাঁকাকে বড় নর্দমা বলে মনে করেন। আমরা এই ধারণা পাল্টাতে চাইছি। রাতারাতি সব কিছু হবে না। কিন্তু বাঁকার উপরে আর যাতে আঘাত না আসে, তা আটকাতেই হবে।’’
বর্ধমান শহরে বাঁকার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫ কিলোমিটার। 'বর্ধমান জেলার নদ-নদী' শীর্ষক বইয়ে বাঁকা নদী-সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ববিদ রঙ্গনকান্তি জানা লিখেছেন, ‘১৮২৯ সালে ফরাসি প্রকৃতিবিদ জ়াকমেঁর বিবরণ অনুযায়ী, বাঁকা সেই সময়ে প্রাণবন্ত ছিল। কিন্তু তা জনবসতির বিস্তৃতিতে বর্জ্য-নালায় পরিণত হয়েছে’। তাঁর কথায়, ‘‘সর্বমঙ্গলার ঘট ভরা হত বাঁকায়। অতিরিক্ত দূষণের জন্যে বেশ কয়েক বছর ধরে আর তা হয় না। শহরের আবর্জনা বুকে নিয়েই বেঁচে রয়েছে।’’
বেশ কয়েক বছর আগে বর্ধমান উন্নয়ন সংস্থা (বিডিএ) পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁকার সংস্কার করেছিল। বীরহাটার কাছে বাঁকার সৌন্দর্যায়নও হয়েছিল। কিন্তু শহরবাসীর একাংশের দাবি, নদীর জল যেখানে কালো কুচকুচে হয়ে গিয়েছে, শহরের মরা জন্তু ফেলার জায়গা হয়ে উঠেছে, সেখানে সৌন্দর্যায়ন বিলাসিতা মাত্র। দুর্গন্ধে বীরহাটার দু’টি সেতুতে দাঁড়ানোই যায় না।
বাঁকার পাড়ে বসবাসকারী মানুষের বক্তব্য, একটু হাওয়া দিলেই দুর্গন্ধ ছড়ায়। জানলা পর্যন্ত খুলে রাখা যায় না। বাঁকা সংস্কার শুরুর পরে আশার আলো দেখেছিলেন বর্ধমানের বাসিন্দারা। ভেবেছিলেন ফিরবে শহরের শ্রী। কিন্তু সে আশা বাস্তবায়িত হয়নি। নদীর মাঝখানে পলি জমেছে। জলের স্রোতও নেই।
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘২০১৩-র একটি তথ্য থেকে জানা যায়, বর্ধমান শহরের ১৫ টনের মতো বর্জ্য বাঁকাতে পড়ে। তখন নদীর গভীরতা ছিল তিন মিটারের বেশি। ১০ বছর পরে সেই ছবি কত ভয়াবহ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।’’ বর্ধমানের গলসির রামগোপালপুর থেকে পূর্বস্থলীর সমুদ্রগড় পর্যন্ত ১২৫ কিলোমিটার বিস্তৃত এই বাঁকা নদী।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের অধ্যাপিকা গোপা সামন্ত বলেন, ‘‘বাঁকাকে নদী হিসেবে কতটা ভাবছি, নদীকে কেন নর্দমায় পরিণত করা হল, এ সব প্রশ্ন ওঠা জরুরি। তার সঙ্গে কী কী ভুল করেছি, সেটাও জানা দরকার।’’ এ কাজে বাঁকার পাড়ের পঞ্চায়েতগুলির শামিল হওয়াও জরুরি, দাবি তাঁর। পুরসভা মনে করছে, নদী সংস্কার, সৌন্দর্যায়ন করার আগে বাঁকা নিয়ে মানুষের ভাবনার বদল দরকার।
পুরপ্রধান জানান, এ দিনের আলোচনার বিষয়বস্তু মাথায় রেখে ভবিষ্যত পরিকল্পনা গড়ে রাজ্যে পাঠানো হবে। রাজ্য থেকে অনুমোদন এলে কাজ শুরু হবে। একটি কমিটি গডারও ডাক দেন তিনি। বিধায়ক খোকন দাস বলেন, ‘‘বর্ধমান পুরসভার ১১টি ওয়ার্ডের মধ্যে দিয়ে এই নদী প্রবাহিত হয়েছে। আগে আমরা সংস্কারের কাজ শুরু করি, তারপরে পঞ্চায়েতগুলিকেও যুক্ত করা হবে।’’ সেচ দফতরের কাছ থেকে টাকা আনতে উদ্যোগী হবেন বলেও
আশ্বাস তাঁর।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)