Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
গুজব-আতঙ্কে ভাড়াবাড়ি ছাড়লেন কাটোয়ার বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা

ফের ছেলেধরা সন্দেহে আটক-মারধর

গুজবের জের থামছে না। এখনও ছেলেধরা, চোর সন্দেহে অচেনাদের আটকে রাখছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আবার এই ভয়েই জেলায় কাজ বন্ধ করে অন্যত্রও পালাচ্ছেন অনেক মহিলা।

সচেতনতা প্রচারে স্কুল পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র।

সচেতনতা প্রচারে স্কুল পড়ুয়ারা। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
মন্তেশ্বর ও কাটোয়া শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:৩৬
Share: Save:

গুজবের জের থামছে না।

এখনও ছেলেধরা, চোর সন্দেহে অচেনাদের আটকে রাখছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আবার এই ভয়েই জেলায় কাজ বন্ধ করে অন্যত্রও পালাচ্ছেন অনেক মহিলা।

দু’দিন আগেই ছেলেধরা, দুষ্কৃতী সন্দেহে কালনার একাধিক জায়গায় বেশ কয়েকজনকে মারধর করা হয়েছিল। গণপিটুনিতে মারাও যান এক জন। তার মধ্যেই সোমবার ছেলেধরা সন্দেহে এক তরুণীকে হেনস্থা করে আটকে রাখার অভিযোগ উঠল মন্তেশ্বরের রায়গ্রামে। রুস্তমপুরে ছাগলচোর সন্দেহে তাড়া করে মারধর করা হয় দুই যুবককে।

জেলা পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবালের দাবি, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া সমস্ত বিষয়ে নজর রাখা হচ্ছে। প্রচার চালানো হচ্ছে বাসে, বাজারে, প্রতিটি গ্রামে ঘুরে। এ দিকে যে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ছড়ানো গুজবে এই ঘটনা সেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও ফুটেজ থেকেই রবিবার রাতে মূল অভিযুক্ত তাপস রায়কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সাত দিন পুলিশ হেপাজত হয় তার। পুলিশ জানায়, ফুটেজে দেখা গিয়েছে রড দিয়ে নদিয়ার হবিবপুর এলাকার পাঁচ জনকে মারছেন তাপস।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন কুসুমগ্রাম পঞ্চায়েতের ঢেরিয়া গ্রামের ওই মহিলা বোরখা পরে রায়গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে গ্রামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে চাঁদা তুলছিলেন। আচমকা ছেলেধরা বলে তাঁকে ঘিরে ধরেন এলাকার কয়েকজন। নাম, ঠিকানা বলার পরেও হেনস্থা কমেনি। এর মধ্যেই ঘটনার কথা কানে যায় মামুদপুর ১ পঞ্চায়েতের প্রধান আজিজুল হকের। তিনিই ওই তরুণীকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে যান। সেখান থেকে পুলিশ ওই তরুণীকে উদ্ধার করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কালনা ১ ব্লকের রুস্তমপুর এলাকায় ছাগল চোর সন্দেহে দুই মোটরবাইক আরোহীকে তাড়া করে আটকে ফেলার ঘটনা ঘটে। তাড়া করে ধর্মডাঙা রেলগেটের কাছে স্থানীয় লোকজন ওই দুই যুবককে ধরে ফেলেন। কাছেই ছিলেন কালনার এক তৃণমূল নেতা শঙ্কর হালদার। তিনিই মারমুখী জনতার মাঝ থেকে ওই দুই যুবককে একটি টোটোয় চাপিয়ে নিয়ে চলে যান বলে জানা গিয়েছে। কালনার এসডিপিও প্রিয়ব্রত রায় বলেন, ‘‘ওই মহিলাকে দ্রুত পুলিশ উদ্ধার করে। মন্তেশ্বর ব্লক জুড়ে গুজবের বিরুদ্ধে প্রচার চলছে।’’

তবে পুলিশ, প্রশাসন যতই সচেতনতার কথা বলুক, আতঙ্ক কাটছে না জেলায় ঘুরে নানা জিনিস বিক্রির কাজ করা পুরুষ-মহিলাদের। শুক্রবার ধাত্রীগ্রামে যে ন’জনকে ছেলেধরা সন্দেহে ঘিরে ফেলেছিলেন গ্রামবাসীরা তাঁদের মধ্যে ছিলেন কাটোয়ায় ভাড়া থাকা এক মহিলাও। দু’দিন পুলিশের কথামতো কাজ বন্ধ করে রাখার পরে এ দিন কাটোয়ার ভাড়া বাড়ি ছেড়ে তারকেশ্বরে চলে গিয়েছেন তাঁরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর পাঁচেক ধরে কাটোয়ার বেলতলার সহদেব পালের বাড়িতে ভাড়া থাকেন জনা এগারো মহিলা। একটি বহুজাতিক সংস্থার হয়ে বর্ধমান ও হুগলির বিভিন্ন শহরতলি ও গ্রামে গিয়ে বিভিন্ন পণ্যের নতুন ক্রেতা তৈরিই কাজ তাঁদের। তাঁদের কারোও বয়স ২০, কারও ৫০। কেউ বিবাহিত, কেউ জিনিস বিক্রির সঙ্গে মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কেউ মুর্শিদাবাদ, কেউ বনগাঁর বাসিন্দা। ওই মহিলারা জানান, তাঁরা অনেকেই সংসারের একমাত্র রোজগেরে। বাড়ি বাড়ি ডিটারজেন্ট, ক্রিম, ন্যাপকিন ফেরি করে মাসের শেষে সামান্য কয়েকহাজার টাকা এঁরা পাঠান বাবা বা স্বামী-সন্তানের কাছে। কিন্তু কালনায় এক দিনে পাঁচ জায়গায় গুজবে বিশ্বাস করে মারধরের ঘটনায় ভয় ধরে গিয়েছে তাঁদের। ওই দিন ধাত্রীগ্রামের মালতীপুরে ছিলেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা বছর আটত্রিশের তপতী ভট্টাচার্য। তিনি জানান, বাড়ি বাড়ি ফেরি করার মাঝে জনা কুড়ি লোক ঘিরে ধরে ছেলেধরা বলে শাসাতে শুরু করে। কোনওরকমে পরিচিত এক জন টেনে বের করে নিয়ে যান তাঁকে।

ওই দিন থেকেই কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন তাঁরা। কাটোয়ার ওই বাড়িয়ে বসে সবিতা, মিঠু, নাসিমারা বলেন, ‘‘পুলিশ দু’দিন কাজ বন্ধ রাখতে বলেছে। কিন্তু আমাদের কাজ না করলে বেতন নেই। কি করে সংসার চলবে?’’ ওই সংস্থার মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ তুষারকান্তি চৌধুরীও বলেন, ‘‘মেয়েদের নিরাপত্তা ও পুলিশের নির্দেশে কাজ বন্ধ রেখেছি। কিন্তু এভাবে কতদিন!’’ তপতী ভট্টাচার্য, সবিতা মণ্ডলদের আশঙ্কা, ‘‘কাজ করব কী? চোর বলে মারে যদি!’’

দু’দিন কাজ বন্ধ রাখার পরে সোমবার কাটোয়ার ওই বাড়ি ছেড়ে তারকেশ্বরে চলে গিয়েছেন তাঁরা। ওই মহিলারা জানান, কালনা-কাটোয়ার দিকে আপাতত কাজ করতে ভয় পাচ্ছেন দলের অনেকে। এক মাস তাই তারকেশ্বর এবং হুগলির অন্য জায়গায় কাজ করবেন তাঁরা। পরিস্থিতি ঠিক হলে ফেব্রুয়ারিতে ফের কাজ করতে আসবেন বর্ধমানে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kidnapper Suspected Lynched
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE