করোনা সংক্রমণের জেরে প্রায় দু’বছর বন্ধ থাকার পরে চারটি শ্রেণির জন্য স্কুল খুললেও পড়ুয়াদের গরহাজিরা নিয়ে চিন্তা কাটছে না শিক্ষকদের। পড়ুয়ারা গেল কোথায়? করোনা সংক্রমণের ভয়েই কি ‘অনীহা’? না কি স্কুলছুট হয়ে গিয়েছে অনেকে? খোঁজ নিতে বর্ধমানের কিছু শিক্ষক পড়ুয়াদেরই দুয়ারে হাজির হচ্ছেন। কাউকে বুঝিয়ে স্কুলে আনতে রাজি করানো হচ্ছে। কেউ আবার বিয়ে করে অন্যত্র শ্বশুরবাড়ি চলে গিয়েছে শুনে হতাশ হতে হয় শিক্ষকদের।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা নাগাদ বর্ধমান ১ ব্লকের কৃষ্ণপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সৌমেন কোনার আরও তিন শিক্ষককে নিয়ে হাজির হন স্থানীয় বাগানবাড়ি ও গিমটি ফটক এলাকায়। সেখানে রাস্তায় স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র বাবু দাসকে দেখতে পেয়ে তাঁরা ঘিরে ধরেন। ‘‘কেন স্কুল যাচ্ছিস না?’’— শিক্ষকেরা প্রশ্ন করেন। ছলছলে চোখে বাবু বলে, ‘‘কিছু দিন আগে বাবা মারা গিয়েছে। বাড়িতে মা একা। আর পড়াশোনা করতে পারব না স্যর। সংসার চালাতে এ বার কাজ খুঁজতে হবে।’’ এ সময়ে বেশ অসহায় দেখায় শিক্ষকদের।
ছাত্রকে সান্ত্বনা দিয়ে তাঁরা বাবু দাসের মা সীমা দাসের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তিনি শিক্ষকদের কথা দেন, ‘‘যে ভাবেই হোক ছেলেকে স্কুলে পাঠাব।’’ স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘‘ওদের পরিবারের অসহায় অবস্থার কথা বুঝতে পারছি। কিন্তু পড়াশোনা ছাড়লে চলবে না। তাই ওদের আমরাই সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছি।’’
এর পরে তাঁরা স্কুলে না যাওয়া ওই এলাকার আরও কয়েক জন পড়ুয়ার বাড়িতে যান। এলাকায় খোঁজ নিয়ে তাঁরা জানতে পারেন, মানস মাল নামে এক ছাত্র গাড়ির শো-রুমে কাজ করছে। তার বাড়িতে গিয়ে শিক্ষকেরা বোঝান। সোমবার থেকে তাকে স্কুলে পাঠানোর কথা জানিয়েছেন মানসের দাদু ভোলা মাল। এ ছাড়া, রেশমা খাতুন, পায়েল খাতুন, সৌমেন দাসেরাও নানা কারণে স্কুলে আসছিল না। তাদেরও বুঝিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা বলেন শিক্ষকেরা।
স্কুলের শিক্ষক সামসুদ্দাও আলম, বিধানচন্দ্র ঘোষ, হিদয়েতুল্লা চৌধুরী বলেন, ‘‘পায়েলের বাড়ির আর্থিক অবস্থা খারাপ। সে সামনের বছর মাধ্যমিক দেবে। আর্থিক দুরবস্থার কারণে সে আর স্কুলে যাবে না ভেবেছিল। তাকে আমরা বলেছি, নাম রেজিস্ট্রেশন করতে। কোনও টাকা লাগবে না। আমরা সে সব খরচ দিয়ে দেব।’’ তাঁদের দাবি, প্রায় পাঁচ থেকে ছয় জন পড়ুয়া ওই এলাকা থেকে স্কুলে ফিরবে বলে জানিয়েছে।
বর্ধমান শহরের তেজগঞ্জ হাইস্কুলের শিক্ষকেরাও এ দিন তেজগঞ্জ, বাঁধপাড়া, সদরঘাট দাসপাড়ায় যান। সেখানে গিয়ে তাঁরা দেখেন দশম শ্রেণিরএক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সে এখন বাঁকুড়ায় শ্বশুরবাড়িতে থাকে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সন্দীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ওর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। পালিয়ে বিয়ে করার কারণে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। দেখা যাক, যোগাযোগ করা যায় কি না।’’ স্কুলের সহকারী শিক্ষক প্রতনু রক্ষিত, অন্যন্যা ভট্টাচার্যেরা বলেন, ‘‘আরও কিছু ছাত্রছাত্রী নানা কারণে স্কুলে ফিরছিল না। তাদেরও বোঝানো হয়েছে। তাঁরা স্কুলে ফিরবে বলে জানিয়েছে।’’ শিক্ষকেরা জানান, পড়ুয়াদের ফেরাতে তারা নিয়মিত অনুপস্থিত থাকা ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে যাবেন।
জেলা স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) শ্রীধর প্রামাণিক বলেন, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের স্কুলমুখী করতে, তাদের সমস্যা জানতে যদি শিক্ষকেরা বাড়ি বাড়ি যান, এটা অবশ্যই সদর্থক ভূমিকা। তাঁদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।’’