Advertisement
E-Paper

উত্‌সব এলেই প্রকট স্বাস্থ্য পরিষেবার দৈন্য

শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবার নানা খামতি, না থাকা এ শহরের রোজনামচা। কিন্তু যে উত্‌সবে ভোল বদলে যায় শহরের, সে ক’দিনও কী পরিস্থিতি অন্যরকম হতে নেই প্রতি বছর রাস এলেই দাঁইহাটবাসীদের এ প্রশ্ন প্রকট হয়ে ওঠে। তালিতাপ্পি মেরে সাময়িক কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু উত্‌সব মিটলেই আলোর খোলস ছেড়ে শহর ফেরে পুরনো অলিগলিতে।

সৌমেন দত্ত

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:১৪
রাসের জন সমাগম।

রাসের জন সমাগম।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবার নানা খামতি, না থাকা এ শহরের রোজনামচা। কিন্তু যে উত্‌সবে ভোল বদলে যায় শহরের, সে ক’দিনও কী পরিস্থিতি অন্যরকম হতে নেই প্রতি বছর রাস এলেই দাঁইহাটবাসীদের এ প্রশ্ন প্রকট হয়ে ওঠে। তালিতাপ্পি মেরে সাময়িক কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু উত্‌সব মিটলেই আলোর খোলস ছেড়ে শহর ফেরে পুরনো অলিগলিতে।

রাস উত্‌সবে শাক্ত এবং বৈষ্ণবের অদ্ভুত সহাবস্থান দেখা যায় দাঁইহাটে। কালী পুজো করে উত্‌সব শুরু হয় এখানে। কথিত রয়েছে, প্রাক-চৈতন্য যুগ থেকে রাস উত্‌সবের প্রচলন রয়েছে। সেই সময় রাস পূর্ণিমার দিনে এই এলাকার তান্ত্রিকেরা পটের মাধ্যমে আরাধনা করতেন। বিসর্জনের দিনে নৌকা করে পটগুলিকে ভাগীরথীতে ঘোরানো হত। দাঁইহাটের রাস একসময়ে ‘পট পূর্ণিমা উত্‌সব’ নামেও পরিচিত ছিল। তারপর ধীরে ধীরে শাক্ত মতাবলম্বরীরাও রাসে মেতে ওঠেন।

নবদ্বীপ, শান্তিপুরের মতোই সারা বছর ধরে রাসের প্রস্তুতি চলে দাঁইহাটে। একদিকে থিমের বাহার, অন্য দিকে বিসর্জনের ট্যাবলোয় রীতিমতো লড়াই চলে ক্লাবগুলির। ওই ক’দিন শহর কাটোয়া তো বটেই আশপাশের বহু গ্রাম থেকেও বহু মানুষ আসেন। বাড়িতে ভিড় বাড়ে ভিন জেলার আত্মীয়দেরও। উত্‌সবে ভর করে জেগে ওঠে ব্যবসা-বাণিজ্যও। অথচ যে রাস দাঁইহাটবাসীর বেঁচে থাকার অন্যতম রসদ, সেই উত্‌সবের জন্যই কোনও পরিকাঠামো নেইরান্নার গ্যাসের ডিলার দেবু পোদ্দার থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় রাস উত্‌সব কমিটির সম্পাদক সন্দীপ দাস সকলের প্রশ্ন একই। স্থানীয় মানুষজনের ক্ষোভ, রাসের সময়ে কয়েক হাজার মানুষের ভিড় হয়। কিন্তু তাঁদের জন্য কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র, শৌচাগার গড়ে ওঠেনি। নেই সুষ্ঠু পানীয় জলের ব্যবস্থাও।

দাঁইহাটের গবেষকেরা জানান, কাটোয়ার আগেই দাঁইহাট শহরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দাতব্য চিকিত্‌সাকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। কাটোয়াতে যেখানে ১৮৬০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দাতব্য চিকিত্‌সা কেন্দ্র তৈরি হয়, তার বহু আগে ১৮০২ সালের ১ জুন দাঁইহাটে দাতব্য চিকিত্‌সালয় গড়ে ওঠে। দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বপন ঠাকুর জানান, ১৯০৭ সাল থেকে ১৯০৯ সালের একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দাঁইহাটে ৫৫০২ জন বাসিন্দার চিকিত্‌সা হয়েছিল। তার মধ্যে ২৬৮ জনের অস্ত্রোপচারও হয়েছিল। কিন্তু এখন যেন পিছন দিকে হাঁটছে দাঁইহাট। স্বপনবাবু বলেন, “দাঁইহাটের বাসিন্দাদের কাছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটাই যেন মৃত।”

এ শহরের বাসিন্দাদের চিকিত্‌সা পেতে হলে পাশের গ্রাম অথবা শহরে যেতে হয়। কয়েক কিলোমিটার দূরে কাটোয়া ২ ব্লকের ন’পাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রর উপরে দাঁইহাটের বাসিন্দাদের একাংশ নির্ভরশীল। বাকি অংশের মানুষকে রাতবিরেতে ছুটে যেতে হয় পাশের শহর কাটোয়ায়। ন’পাড়ায় অবস্থিত কাটোয়া ২ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিত্‌সক (বিএমওএইচ) চন্দ্রশেখর মাইতি বলেন, “আমাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেশিরভাগ রোগীই পার্শ্ববর্তী দাঁইহাট এলাকার বাসিন্দা।” এছাড়া দাঁইহাট পুরসভার উদ্যোগে তিনটি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র চলে বটে, কিন্তু তার পরিষেবা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। একটি বেসরকারি নার্সিংহোম থাকলেও ওই নার্সিংহোম চিকিত্‌সার জন্য কাটোয়ারই মুখাপেক্ষী। দাঁইহাটের পুরপ্রধান সন্তোষ দাসের অবশ্য আশ্বাস, “ভারত সেবাশ্রমের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। বহির্বিভাগ চালুও হয়ে গিয়েছে।”


তৈরি হচ্ছে ভারত সেবাশ্রমের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে চিকিত্‌সাকেন্দ্র।

স্বাস্থ্যের সঙ্গে এ শহরে অবহেলিত রয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থাও। ১৮৫৫ সালের ২৯ অক্টোবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘দাঁইহাট মডেল স্কুল’। বর্তমানে সেই স্কুল নাম পাল্টে হয়েছে দাঁইহাট হাই স্কুল। শহরে কলেজ গড়ারও জোরালো দাবি উঠছে। তাকে ঘিরে দিনের পর দিন রাজনৈতিক চাপানউতোরও বাড়ছে। দাঁইহাটে হৃষিকেশ মিত্র মেমোরিয়াল কলেজ তৈরির জন্য ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেই বছরেই দাঁইহাট উচ্চ বিদ্যালয় কলেজের নামে ৬ বিঘা জমি দান করে। তারপর কোনও অজ্ঞাত কারণে সেই প্রচেষ্টা থমকে যায়। এর মধ্যে রাজ্যে নতুন সরকার আসে। ২০১১ সালের ২৮ জুলাই শিক্ষা দফতরের সহ সচিব কে সি আচার্য কলেজ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র শিক্ষা দফতরে জমা দেওয়ার জন্য দাঁইহাটের পুরপ্রধানকে চিঠি দেন। পুরসভা সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে কলেজের নামে জমি দান করে দাঁইহাট উচ্চবিদ্যালয়। একদা দাঁইহাটের বাসিন্দা বর্তমানে কলকাতার হাজরা রোডের শ্যামলেন্দু মিত্র গত আর্থিক বছরে এই কলেজ তৈরির জন্য কুড়ি লক্ষ টাকা দান করেন। পুরপ্রধান বলেন, “শিক্ষা দফতরের সমস্ত নিয়মকানুন মেনে আমরা কাগজপত্র জমা দিয়েছি। তারপরেও রাজ্য সরকার কী কারণে কলেজ তৈরির অনুমোদন দিচ্ছে না, বুঝতে পারছি না।”

এরমধ্যেই ‘পরিচয়’ নামে এক সংস্থা গড়ে যুবক-যুবতীরা শহর বাঁচানোর উদ্যোগ করেছেন। ইতিমধ্যেই কলেজ তৈরির দাবি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন তাঁরা। ওয়েবসাইট তৈরি করে দাঁইহাটের ইতিহাস-সহ নানা বিষয় তুলে ধরেছেন। ওই সংস্থার সদস্য অভিষেক সাহা, দেবশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়দের দাবি, “রাসে প্রচুর মানুষ শহরে আসেন, অথচ কোনও কমিউনিটি শৌচাগার নেই। পুরসভার ৪০ শতাংশ বাড়িও শৌচাগারহীন।”

পরিষেবা না থাকায় শহরে জনসংখ্যা সেভাবে বাড়ছে না। ‘নেই রাজ্যে’ সরকারি অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো অনেক কিছুই। কাঁসা-পিতলের ব্যবসাও সেভাবে বাড়ছে না। তবে শীত পড়তেই দাঁইহাটের নাম উঠে আসে একটা কারণে। সে হল খেজুর গুড়। খেজুর গুড়ের চাহিদা এবং জোগানে এ শহর এখনও টেক্কা দেয় অনেককেই।

(চলবে)
ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

amar shohor soumen dutta daihat health service celebration time
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy