Advertisement
১৮ মে ২০২৪

কারও নজর এখন মহাকাশে, কারও শুধু মায়ের কষ্ট লাঘবে

শুধু পড়াশোনায় আটকে থাকাই জীবন নয়। তাই মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার ইচ্ছে যেমন রয়েছে, তেমনই জেলা স্তরের অ্যাথলিট হওয়ার স্বপ্নও দেখে বর্ধমানের টাউন স্কুলের দ্বৈপায়ন দুবে। মাধ্যমিকে রাজ্যে সম্ভাব্য পঞ্চম হওয়ার পরে এ কথা জানায় সে।

রানা সেনগুপ্ত ও সৌমেন দত্ত
বর্ধমান ও কাটোয়া শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৪ ০২:০০
Share: Save:

শুধু পড়াশোনায় আটকে থাকাই জীবন নয়। তাই মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার ইচ্ছে যেমন রয়েছে, তেমনই জেলা স্তরের অ্যাথলিট হওয়ার স্বপ্নও দেখে বর্ধমানের টাউন স্কুলের দ্বৈপায়ন দুবে। মাধ্যমিকে রাজ্যে সম্ভাব্য পঞ্চম হওয়ার পরে এ কথা জানায় সে।

কুড়মুন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ফামার্সিস্ট দেবব্রত দুবের ছেলে দ্বৈপায়ন পেয়েছে ৬৭৮ নম্বর। কিন্তু এই ফলে সে যেমন খুশি নয়, তেমনই খুশি নন স্কুলের প্রধান শিক্ষক আশিসকুমার নন্দীও। দু’জনেই খাতা রিভিউ করাতে চান, বিশেষত ইংরেজির। আশিসবাবুর দাবি, ইংরেজিতে আরও বেশি নম্বর পাওয়া উচিত ছিল দ্বৈপায়নের।

তবে ফল ভাল হওয়ার জন্য দ্বৈপায়ন ধন্যবাদ দিয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত শিক্ষক বিশ্বজিৎ পালকে। আর ধন্যবাদ দিতে চায় সোমনাথ গুপ্তকে, যিনি তাকে দেশবিদেশের বিজ্ঞানীদের গল্প শুনিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছেন। তাঁর কথা মতো মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়া করতে চায় সে। তবে বাবা-মায়ের মন রাখতে এক বার জয়েন্ট এন্ট্রান্সে বসে নিজের যোগ্যতা প্রমাণও করতে চায়। বাবা দেবব্রতবাবু অবশ্য ছেলে কী নিয়ে লেখাপড়া করবে, সে নিয়ে তাকে চাপ দিতে নারাজ। তাঁর কথায়, “কোনও দিন পড়তে বসতে বলতে হয়নি ওকে। নিজেই পড়েছে। খেলেছে। তার পরে ভাল ফলও করেছে।” লেখাপড়া ছাড়া শটপাট আর ডিসকাস থ্রো দ্বৈপায়নের প্রিয় বিষয়। টাউন স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, “গত তিন বছর আমাদের স্কুল থেকে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে কেউ মেধাতালিকায় ঠাঁই পায়নি। এ বার খরা কাটল।’’

১) প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দ্বৈপায়ন।

২) বাবা-মায়ের সঙ্গে সায়ন্তী।

৩) রোহিতরাম শর্মা।

৪) বাবা-মায়ের সঙ্গে পীযূষকান্তি নাগ।

৫) পরিবারের সঙ্গে পারিজাত।

৬) ঋত্বিক পাল।

কাটোয়া দুর্গাদাসী চৌধুরানি বালিকা বিদ্যালয়ের (ডিডিসি) ছাত্রী সায়ন্তী মণ্ডল ৬৭৭ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিকের সম্ভাব্য ষষ্ঠ। ওই স্কুলেরই পারিজাত দত্ত ৬৭৬ নম্বর পেয়ে সম্ভাব্য সপ্তম। দু’জনের কেউই স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় হয়নি কোনও দিন। তবে দু’জনের নম্বর সব সময় কাছাকাছি থাকত। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষার ফলেও সেই ধারা বজায় থাকল।

বৃহস্পতিবার সকালে খবর ছড়িয়ে পড়ার পরেই খুশির হাওয়া দুই বাড়িতে। স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিবারের মেয়ে পারিজাত বলে, “ভাল পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তাই ভাল ফল আশা করেছিলাম। মেধাতালিকায় থাকায় ভাল লাগছে। গৃহশিক্ষকদের পাশাপাশি পারিজাত কৃতজ্ঞ তার মা পূরবীদেবীর প্রতি। সে বলে, “মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ছাড়া এই ফল হত না।”

কাটোয়া সার্কাস ময়দানে সরকারি আবাসনে বসে সায়ন্তী বলে, “গৃহশিক্ষকরা বেশি করে ‘টাস্ক’ দিত, তাই পড়া হত। তা না হলে পড়ার ব্যাপারে আমি খুবই ফাঁকিবাজ। পড়ার বদলে ছবি আঁকতেই আমার বেশি ভাল লাগে।” সায়ন্তীর দাদা নিরুপম ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র। সায়ন্তীর ইচ্ছা, ভবিষ্যতে চিকিৎসক হবে। তার বাবা নবশ্যামবাবু কেতুগ্রাম ব্লকের সমাজকল্যাণ আধিকারিক। তাঁর কথায়, “আমরা কোনও দিনই পড়ার ব্যাপারে চাপ দিতাম না। তবে নিরুপম ও আমার কাছে পড়তে ভালবাসত।” সায়ন্তীর প্রিয় বিষয় অঙ্ক ও জীবন বিজ্ঞান। সে বলে, “এত ভাল ফল হবে আশা করিনি।” সে জানায়, স্কুলে শিক্ষিকারা যত্ন নিয়েই পড়ান। কিন্তু পড়ুয়ারাই স্কুলে যেতে চায় না। পড়া আর ছবি আঁকার মাঝে হ্যারি পটার নিয়ে পাগল সায়ন্তী।

পারিজাতের মাতামাতি আবার মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে নিয়ে। জয়েন্ট এন্ট্রান্সের জন্য কলকাতায় নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার মধ্যেই আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসের খেলা দেখতে বাদ দিচ্ছে না সে। ফল বেরোনোর পরে মাঝে-মাঝেই বোন প্রকৃতি আদর করে যাচ্ছে তাকে। পারিজাত জানায়, রহস্য উপন্যাস থেকে সব রকম গল্পের বই পড়তে ভালবাসে সে। এ ছাড়া ভালবাসে কবিতা লিখতে, আবৃত্তি করতে। কাটোয়ার প্রেস ব্যবসায়ী নিমাইপ্রসাদ দত্ত বলেন, “মেয়ে ভাল ফল করবে, সে নিয়ে সন্দেহ ছিল না। এই ফল পারিজাতের দায়িত্ব বাড়াল।”

গলসি উচ্চ বিদ্যালয়ের পীযূষকান্তি নাগ ৬৭৪ পেয়ে এ বার রাজ্যের মধ্যে সম্ভাব্য নবম। তার বাবা সৈরেশ নাগ অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক। তাঁর পেনশনের টাকায় সংসার চলে। বৃহস্পতিবার অবশ্য সৌরেশবাবু ও তাঁর স্ত্রী সোমাদেবীর মুখে হাসি ফুটেছে। প্রতিবেশীরা তাঁদের অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছেন। পীযূষ বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

ভাতারের মাধব পাবলিক স্কুলের ঋত্বিক পাল ৬৭৩ পেয়ে মাধ্যমিকের সম্ভাব্য দশম। তার বাড়ি হাড়গ্রামে। বাবা মধুসূদন পাল পেশায় ব্যবসায়ী। ঋত্বিকের লক্ষ্য আপাতত বিজ্ঞান নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল ফল করা। তার পরে সে আইএএস বা আইপিএস হতে চায়। তার কথায়, ‘‘আমলারাই দেশের সমস্ত উন্নয়ন বাস্তবায়িত করেন। তাই আমি আইএএস বা আইপিএস হতে চাই।’’

মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছে বর্ধমান টাউন স্কুলের রোহিতরাম শর্মাও। এ বার মাধ্যমিকে ৬১৬ পেয়েছে সে। বাবা ছিলেন দিনমজুর। ২০০৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে রোহিতের মা মনুদেবী একটি দর্জির দোকানে কাজ করছিলেন। কিন্তু বাজেপ্রতাপপুর সুভাষপল্লির বাসিন্দা মনুদেবীকে ২০০৯ সালে ধাক্কা মারে একটি মালবোঝাই ট্রাক। ডান পা চিরতরে অকেজো হয়ে যায়। এতটাই যে, দর্জির দোকানে কাজ করার সক্ষমতাও হারান। বাধ্য হয়ে কখনও পরিচারিকার কাজ করে, কখনও হোটেলে বাসন মেজে বা কখনও চেয়েচিন্তে তিনি ছেলেকে পড়িয়েছেন তিনি। স্কুল অবশ্য এই দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রের সমস্ত খরচ বহন করে চলেছে। স্কুলের শিক্ষকদের চেষ্টাতেই রোহিত এ বার ভাল ফল করেছে, পেয়ে গিয়েছে জীবনে এগিয়ে চলার আত্মবিশ্বাস। প্রধান শিক্ষক আশিসকুমার নন্দী বলেন, “ছেলেটি ভাল ফল করার পরেই আমরা তার মাকে ডেকে বলেছি, ও যত দূর পড়বে, পড়ার সমস্ত খরচ দেব আমরা। অন্য যা যা দরকার হয়, তা-ও দেব। ওকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।’’ বড় হয়ে কী হবে? কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে রোহিত বলে, “এমন একটা কিছু হতে চাই, যেটা হলে মাকে আর ভাঙা পা নিয়ে কাজ করতে যেতে হবে না।’’

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

madhyamik result rana sengupta saumen dutta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE