রস জাল দিচ্ছেন এক গ্রামবাসী। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা পরিকাঠামোয় অনুন্নয়ন থেকে নামেই পুরসভার তকমা-- এ শহরের না পাওয়ার ইতিহাস বহু। ভাগীরথীকে কেন্দ্র করে একসময় যে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি চরমে পৌঁছেছিল তাও এখনও ইতিহাস। তবু শীত নামলেই যেন কিছুটা চাঙ্গা হয় দাঁইহাট। কেন?
খেজুর গুড়ের জোগানে রাজ্যের অন্যতম নাম এ তল্লাটের। প্রতি বছরই উত্কৃষ্ট পাটালি তৈরি করে নানা জেলা তো বটেই কলকাতার বাজারেরও দখল নেয় দাঁইহাট। পশ্চিমবঙ্গ তাল ও খেজুর কো-অপারেটিভ লিমিটেডের অন্যতম কর্ণধার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ফলতার বাসিন্দা অশোককুমার মণ্ডলও বলেন, “কলকাতার বাজারে দাঁইহাটের পাটালির চাহিদাই সবচেয়ে বেশি।” কয়েক বছর আগে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও লিখেছিলেন, ভাগীরথী তীরবর্তী দাঁইহাটে সবচেয়ে উত্কৃষ্ট মানের খেজুর রস উত্পাদন হয়।
শোনা যায়, খেজুর রস জাল দিয়ে যে অমন শক্ত আর সুস্বাদু গুড় যে তৈরি করা যায় তা প্রথম দেখিয়েছিল কাটোয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম পাটুলি। বর্ধমানের ওই গ্রামের নাম থেকেই নাকি গুড়ের নাম হয় পাটালি। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কাটোয়ার বাসিন্দা কৌশিক ব্রহ্মচারীও বলেন, “নদী তীরবর্তী হওয়ায় ওই এলাকার মাটি উর্বর। আবহাওয়ায় খেজুর গাছের উপযোগী। তাছাড়া বহুদিন ধরে ওই কাজ করে আসায় বাসিন্দারাও গুড় তৈরিতে পারদর্শী।”
ভাগীরথীর তীর বরাবর দাঁইহাটের পাঁচটি ওয়ার্ডের মানুষ সরাসরি পাটালি তৈরির কাজে যুক্ত। শীতের চার মাস সপরিবারে খেজুর রস জাল দিয়ে পাটালি তৈরির কাজ করেন তাঁরা। প্রায় ২০০টি পরিবার পাটালি প্রস্তুত করেন। রস সংগ্রহ থেকে গুড় বাজারজাত করা পর্যন্ত প্রায় দু’হাজার লোক এ কাজের সঙ্গে জড়িত। বছরের অন্য সময় অবশ্য তাঁদের অনেকেই চাষাবাদ করেন। কেউ কেউ আবার সব্জি বা মাছ চাষ কিংবা ভ্যান চালানোর কাজও করেন। তাঁদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, এই চার মাসে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা লাভ করেন তাঁরা। সরাা বছরের সঞ্চয় সেটাই। আবার ঋণ শোধ করতেও সে টাকার অনেকটা চলে যায় বলে কয়েকজনের দাবি। পাটালি প্রস্তুতকারকদের দাবি, চাষাবাদ করে কোনওদিনই এ টাকা আয় করতে পারতেন না তাঁরা।
তবে পাটালি তৈরির রাস্তা মোটেও সুগম নয়। দাঁইহাটের নিশীথ মণ্ডল, রেণুকা রায়েরা জানান, ভোর ৪টেয় দিন শুরু হয় তাঁদের। প্রথমেই খেজুর গাছ থেকে ‘ঠিলে’ (গাছে লাগানো হাঁড়ি) খোলার পালা। রসের হাঁড়ি নামাতে নামাতেই ঘণ্টা দেড়েক পার। তারপরে শুরু হয় রস জাল দেওয়া। পাটালি প্রস্তুতকারকদের একজন, কালীপদ মণ্ডল জানান, একেক ঠালি থেকে গুড় বানাতে অন্তত ৪৫ নিমিট লাগে। তিনি আরও জানান, মূলত দু’রকমের গুড় তৈরি হয়। একটা নলেন গুড় বা ঝোলা গুড়। আরেকটা পাটালি বা কড়া পাকের গুড়। পাটালি তৈরির ক্ষেত্রে রস জাল দেওয়ার পরেই তা ছাঁচে ফেলা হয়। এরমধ্যেই দুপুর গড়িয়ে যায়। রোজকার নাওয়া-খাওয়া সেরে এরপরে আবার পুরুষেরা ছোটেন গাছে হাঁড়ি বাঁধতে। আর বাড়ির মহিলারা জুটে যান গুড় প্যাকেজিংয়ের কাজে।
বর্ধমান, নবদ্বীপ, কাটোয়া, কৃষ্ণনগর থেকে ব্যবসায়ীরা নিয়মিত পাটালি কিনতে আসেন এ তল্লাটে। পাটালি প্রস্তুতকারকদের দাবি, মিলন মেলায় প্রতিদিন ১০০ কেজি পাটালি যায় দাঁইহাট থেকে। বাকি পাটালি স্থানীয় সমবায় সমিতি, চরপাতাইদের মাধ্যমে কিনে নেয় পশ্চিমবঙ্গ তাল ও খেজুর কো-অপারেটিভ লিমিটেড। একেকজন গুড় প্রস্তুতকারক গড়ে তিনশোটি করে খেজুর গাছ ভাড়া নেন। প্রতি মরসুমে গাছি পিছু ভাড়া দিতে হয় ১০০ টাকা। গাছ থেকে একবার হাঁড়ি খোলার তিন দিন পরে আবার নতুন হাঁড়ি লাগানো হয়। ফলে ১০০টি করে গাছ থেকে দৈনিক রস সংগ্রহ করা হয়। বাইরে থেকেও অনেকে কাজ করতে আসেন এ সময়ে। ওই এলাকারই ফণীভূষণ রায় বলেন, “তিন ধরনের পাটালি তৈরি করা হয়। একটা শুধুই খেজুর রস দিয়ে। বাজারে যার দাম প্রায় ১২০ টাকা কেজি। কিন্তু সাধারণ মানুষ ওই দামে গুড় কিনতে না পারায় রসের সঙ্গে চিনি মিশিয়েও পাটালি তৈরি করি। তার দাম পড়ে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি।”
তবে এর মধ্যেও না পাওয়া, খণ নিয়ে মুশকিল, চড়া সুদ এ সমস্ত সমস্যা রয়েছে। পাটালি প্রস্তুতকারক অনিতা মণ্ডল, নিশীথ মণ্ডলদের অভিযোগ, বিড়ি শ্রমিকেরা সরকারের কাছ থেকে নানা সাহায্য পায়। কিন্তু সে ধরণের সুবিধা পান না তাঁরা। সরকারের তরফে প্রয়োজনীয় খণ পেলে গুড়ের ব্যবসা আরও ভাল হত বলেও তাঁদের দাবি। গুড় জ্বাল দিতে দিতেই তাঁদের এক জন আনমনে বলে ওঠেন, “পাটালি আমরা তৈরি করি ঠিকই, কিন্তু লাভের গুড় খেয়ে যায় অন্য পিঁপড়েতে।”
(শেষ)
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
subject-এ লিখুন ‘আমার শহর বর্ধমান’। প্রতিক্রিয়া জানান www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, বর্ধমান বিভাগ, জেলা দফতর আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy