Advertisement
২৬ মে ২০২৪

দেদার চলছে মাটি চুরি, বিপন্ন নদীপাড়ের চাষাবাদ

রাত বাড়তেই ঝুপঝাপ শব্দ, ফিসফাস কথা। জানালার খড়খড়ি তুলতেই চোখে পড়ে, ভাগীরথীর জলে কাঠের ট্রলারে বোঝাই হচ্ছে পাড়ের মাটি। তবে আলো ফুটতে না ফুটতেই সব শান্ত। মাটিভর্তি ট্রলার মিলিয়ে গিয়েছে দূরে। প্রশাসনের তরফে বারবার অভিযানের পরেও কালনা ২ ব্লকের পূর্ব সাতগাছিয়ায় মাটি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাড়ের ভাঙনও। পূর্ব সাতগাছিয়ার হাসপুকুর, কুলেদা, শতপটি গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রতিদিনই একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে গ্রাম। বেশ কিছু চাষের জমি তো ইতিমধ্যেই নদীগর্ভে।

পাড় থেকে কয়েক কিলোমিটার ভেতরেও চলছে মাটি কাটা। পূর্ব সাতগাছিয়ায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

পাড় থেকে কয়েক কিলোমিটার ভেতরেও চলছে মাটি কাটা। পূর্ব সাতগাছিয়ায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য
কালনা শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৪ ০১:০১
Share: Save:

রাত বাড়তেই ঝুপঝাপ শব্দ, ফিসফাস কথা। জানালার খড়খড়ি তুলতেই চোখে পড়ে, ভাগীরথীর জলে কাঠের ট্রলারে বোঝাই হচ্ছে পাড়ের মাটি। তবে আলো ফুটতে না ফুটতেই সব শান্ত। মাটিভর্তি ট্রলার মিলিয়ে গিয়েছে দূরে। প্রশাসনের তরফে বারবার অভিযানের পরেও কালনা ২ ব্লকের পূর্ব সাতগাছিয়ায় মাটি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পাড়ের ভাঙনও।

পূর্ব সাতগাছিয়ার হাসপুকুর, কুলেদা, শতপটি গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রতিদিনই একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে গ্রাম। বেশ কিছু চাষের জমি তো ইতিমধ্যেই নদীগর্ভে। চাষিদের দাবি, প্রতিদিনই রাত আড়াইটে নাগাদ হাসপুকুর, মালোপাড়া, নিভুজিবাজার-সহ বেশ কিছু এলাকার কাঠের ট্রলার নদীতে ভিড়তে শুরু করে। একেকটা ট্রলারে থাকে সাত থেকে দশ জন। পাড়ে নেমেই মাটিতে কোদালের কোপ চালাতে শুরু করে তারা। তিন গ্রামের কিলোমিটার দুয়েক এলাকা জুড়ে দশ থেকে বারোটি ট্রলার বেআইনি মাটি কাটার কাজ চালাতে থাকে। ভোরের আলো ফুটতে ট্রলারগুলি নদীপথেই অন্যত্র চলে যায়। তবে কারবার থেমে থাকে না। সূর্য ওঠার পরে কারবার ফেরে অন্য চেহারায়। চাষিদের দাবি, মাটির কারবারিরা সকালে কিছু নিদিষ্ট পাট্টা প্রাপকদের জমি থেকে মাটি। কাটে। নির্দিষ্ট চুক্তিতে জমি মালিকেরা সেই মাটি দেয়। চুক্তি হয় দু’ভাবেকেউ গোটা জমির দেড় থেকে দু’ফুট মাটির জন্য চুক্তি করে, কেউ আবার ৫০ থেকে ৭০ টাকা ট্রাক্টর পিছু মাটি বিক্রি করে দেয়। তবে একটা জমির মাটি বিক্রি হলেই আশপাশের জমি উঁচু হয়ে সেখান থেকে জল জমা হয় নীচু জমিতে। ফলে সেই জমিও বিক্রি করা উপায় থাকে না বলে চাষিদের দাবি। আবার পাট্টা প্রাপকদের একাংশের দাবি, প্রতি বার বর্ষায় যে পরিমাণ পলি জমা হয়, তাতে কাটার পরিমাণ অনেকটাই পুষিয়ে যায়। ফলে চাষ না করেও কিছু টাকা আসে হাতে। কিন্তু বেআইনি কারবারে বাধা দেন না কেন স্থানীয় বাসিন্দারা? তাঁদের কথায়, “রাতের কারবারে বাধা দিতে গেলে বোমা-গুলিও ধেয়ে আসতে পারে। প্রাণভয়ে তাই মুখে কুলুপ এঁটেই থাকেন তাঁরা।”

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এখন গ্রামগুলি যে এলাকায় অবস্থিত বহু বছর আগে সেখান দিয়েই গতিপথ ছিল ভাগীরথীর। পরে পথ বদলে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চর পড়ে যায়। চরের মাটিতে শুরু হয় চাষাবাস। সরকারের তরফে বেশ কিছু কৃষককে পাট্টাও দেওয়া হয়। তারপর থেকে প্রতিবারই বর্ষায় ভাগীরথীর জল উপচে পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় পলি জমা হয়। সেই পলি মেশা মাটি ইটভাটা-সহ নানা কাজে ব্যবহার হয়। ট্রাক্টর পিছু ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হয় সেই মাটি।

তবে লাগাতার মাটি কাটায় এক দিকে যেমন ভাঙন বাড়ছে, তেমনি চাষাবাদও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ চাষিদের একটি বড় অংশও। সম্প্রতি এলাকায় বেআইনি মাটি কাটা বন্ধ করতে শাসকদল তৃণমূলের পঞ্চায়েত সভাপতি বলাই উপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হয়েছিলেন চাষিদের একাংশ। দলেরই কয়েকজন ওই কারবারে যুক্ত বলে অভিযোগও করেন তাঁরা। অভিযোগ পেয়ে দলের কিছু কর্মীকে নিয়ে এলাকা ঘুরে দেখেন বলাইবাবু। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, বেআইনি মাটির কারবারের বিষয়টি দল ভালভাবে নিচ্ছে না। ইতিমধ্যে এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে সাত জন ট্রলার মালিকের নামের তালিকা তৈরি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তাঁর দাবি, ওই তালিকা ব্লক ভূমি এবং ভূমি সংস্কার আধিকারিকের কাছে জমা দেওয়া হবে। দলের লোক জড়িত কিনা জানতে চাওয়া হলে পঞ্চায়েত সভাপতির জবাব, “সরাসরি দলের সঙ্গে যুক্ত না হলেও দলের নাম ভাঙিয়ে অনেকে কারবার চালাচ্ছে বলে খবর পেয়েছি।” তাঁর দাবি, চাষিদের নিয়ে একটি বৈঠক ডাকার চেষ্টা চলছে। চাষিরা রাজি হলে ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফকরে স্মারকলিপি দিয়ে দোষিদের গ্রেফতারের দাবি জানানো হবে বলেও তাঁর আশ্বাস। বিষয়টি নজরে আনা হয়েছে কালনার বিধায়ক বিশ্বজিত্‌ কুণ্ডুরও। তিনি জানিয়েছেন, পূর্ব সাতগাছিয়ায় বেআইনি মাটি কাটার বিষয়টি পুলিশকে জানানো হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE