পর্যটনদের অপেক্ষায় রাজবাড়ি কমপ্লেক্স।
পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন ভুরিভুরি, অথচ পর্যটকের আনাগোনা সেভাবে নেইকালনা শহর নিয়ে এ অভিযোগ বহু দিনের। বিশেষত, শহর যখন বাড়ছে, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার দাবি আরও জোরালো হচ্ছে, সেই প্রেক্ষিতে এ অভিযোগ আবারও প্রাসঙ্গিক।
ভাগীরথী পাড়ের ছোট এ শহরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের হাতছানি। ১০৮ শিবমন্দির থেকে মসজিদ-ই-মজলিসসবই রয়েছে স্বমহিমায়। কোনও স্থাপত্যের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে ভারতীয় সর্বেক্ষণ, কারও যত্নের ভার পুরসভার। কেউ আবার আগাছা, শ্যাওলা মেখে নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। তাহলে পর্যটক আসে না কেন?
উত্তর খুঁজতে গিয়ে পরিকাঠামোর দুর্বলতার দিকটাই সবার আগে উঠে আসে। শহরের অজস্র মন্দিরের মধ্যে ১০৮ শিবমন্দির-সহ কয়েকটি মন্দির রয়েছে পুরাতত্ত্ব বিভাগের দেখভালে। বাকি দাঁতনকাঠি তলার মসজিদ, টেরাকোটার কাজ করা জোড়া শিবমন্দির, সমাজ বাড়ি-সহ বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান পড়ে রয়েছে চূড়ান্ত অবহেলায়। বাহারি বাগান বা রকমারি আলো পর্যটকদের চোখ টানার মতো কোনও ব্যবস্থায় নেই এখানে। তার উপর অযত্নের ছাপ রয়েছে স্থাপত্যের গায়েও। পুকুরের জলে তলিয়ে যেতে বসেছে মসজিদ-ই-মজলিসের একটা অংশও। হাল ফেরাতে পারলে এই সমস্ত পুরাকীর্তিগুলি দেখতে দেশ-বিদেশের বহু পর্যটকের ভিড় জমবে বলে মনে করছেন শহরবাসী থেকে ঐতিহাসিক সকলেই।
ফুলের পাপড়ির মতো সাজানো ১০৮ শিবমন্দির দেখতে পর্যটকদের ভিড় সারা বছরই থাকে। শুধু এ দেশেই নয় মন্দিরের গঠনশৈলীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ বিদেশের বহু মানুষও। মন্দিরের বিপরীতে রয়েছে রাজবাড়ি কমপ্লেক্স। বর্গী হামলায় দাঁইহাটের রাজবাড়ি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে গঙ্গাপাড়ে বসবাসের জন্য বর্ধমানের রাজারা নয়নাভিরাম এ অট্টালিকা তৈরি করেন। তবে সবচেয়ে নজর কাড়ে প্রতাপেশ্বর মন্দির। রাজা প্রতাপচাঁদের প্রথমা মহিষী প্যারিকুমারিদেবী মন্দিরটি তৈরি করান। মন্দিরের চারপাশে বেশ কিছু পৌরাণিক মূর্তি রয়েছে। কিছুটা দূরেই রয়েছে লালজি মন্দির। অনেকের মতে, ২৫ চূড়ার এ মন্দির স্থাপত্যশৈলিতে বাংলার শ্রেষ্ঠ। চোখ টানে রাজবাড়ি কমপ্লেক্সের কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরও। শোনা যায়, বহু বছর আগে বাংলাদেশ থেকে এসে এ শহরে ভবানী মন্দির তৈরি করেছিলেন সাধক ভবা পাগলা। মন্দিরে বসে বহু গানও লিখেছিলেন তিনি। শহরে রয়েছে চৈতন্য স্মৃতিবিজড়িত মহাপ্রভু বাড়ি। মহাপ্রভুর জীব্বদশায় তৈরি তাঁর দারু মূর্তি রয়েছে এখানে। আর এক সাধক ভগবানদাস বাবাজির নামব্রম্ভ বাড়িতে দেখা মিলবে পাতাল কুয়োর। কালনার প্রাচীনতম মসজিদটি সইফুদ্দিন ফিরোজ শাহের সময়ের। এখন অবশ্য সংরক্ষণশালায় রাখা একটি শিলালিপি ছাড়া এ মসজিদের আর কোনও অস্তিত্ব নেই। হারিয়ে গিয়েছে আরও বেশ কিছু মসজিদ। তবে দাঁতনকাটিতলার মসজিদ এখনও নজর কাড়ে। ৬০০ বছরেরও বেশি পুরনো মসজিদ-ই-মজলিসের কিছু খিলান নষ্ট হয়ে গেলেও এর নির্মাণশৈলী মনে ছাপ রেখে যায়। প্রতি বছর ঈদে এখনও উপচে পড়ে মসজিদ চত্বর।
কিন্তু এত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সারা বছর সেভাবে পর্যটকদের ভিড় দেখা যায় না কালনায়। পর্যটক টানতে স্থাপত্যগুলির যত্ন, সংস্কারের পাশাপাশি প্রচারও প্রয়োজন। তার কোনও উদ্যোগ অবশ্য সেভাবে চোখে পড়ে না। পর্যটকেরা বেড়াতে এসে সেই জায়গার কোনও স্মারক বাড়ি নিয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতাও থাকে। কালনাতেও বিশেষ জিনিসের অভাবে নেই। তাঁতের শাড়ি থেকে মাখা সন্দেশ, নোড়া পান্তুয়া--সবেরই খ্যাতি রয়েছে। অথচ পর্যটকদের কাছে সেসব তুলে ধরার চেষ্টা সেভাবে হয় না।
কালনার টেরাকোটার কারুকাজে চোখ আটকেছে মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল-সহ বহু নামী ব্যক্তিত্বের। অথচ টেরাকোটার কোনও স্মারক আজও তৈরি হয়নি। দর্শনীয় স্থানগুলির আশপাশে ভাল রেস্তোরাঁ, দোকানও নেই। এমনকী সন্ধ্যেয় শহর দেখতে পর্যাপ্ত আলোও নেই রাস্তায়। কিছুদিন আগে ত্রিফলা বাতি লাগানো হয়েছে ঠিকই কিন্তু শহরের কিছু অংশেই তা সীমাবদ্ধ। ভাগীরথীর পাড় ঘিরেও সৌন্দর্য্যায়নের পরিকল্পনা সেভাবে হয়নি। এছাড়া পর্যটকদের জন্য বিশেষ নৌকা ভ্রমণ, কোন পথে গেলে কী কী দর্শনীয় স্থান মিলবে তার রোডম্যাপ কোনওকিছুই নেই এ শহরে। শহরের এক শিক্ষক জনার্দন বিশ্বাস জানান, বাইরে থেকে বেশিরভাগই এসে পুজো দিয়ে ফিরে যান। পরিকাঠামোর উন্নতি না হলে ভ্রমণ পিপাসুদের টেনে আনা মুশকিল। জনার্দনবাবুর সঙ্গে সহমত শহরের বেশিরভাগ মানুষই।
পুরপ্রধান বিশ্বজিৎ কুণ্ডুর আশ্বাস, “এ শহরকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠার লক্ষ্য নিয়েই পুরসবা এগোচ্ছে। পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে রাজবাড়ি কমপ্লেক্সে পর্যটন দফতরের সহযোগিতায় আলোর কারুকাজ তৈরি হচ্ছে। যা আট থেকে আশি সকলেরই ভাল লাগবে। এছাড়া মহিষমর্দিনীতলার ঘাটে তৈরি হচ্ছে একটি উন্নত মানের পার্ক। সাজানো হচ্ছে মহিষমর্দিনী তলার ঘাটও।”
ছবি: মধুমিতা মজুমদার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy