Advertisement
১৯ মে ২০২৪
বালি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য/ ২

মাফিয়াদের গোলমালে তটস্থ এলাকা, ঘুম নেই পুলিশেরও

বালি মাফিয়াদের দাপটে সাধারণ মানুষ যেমন ব্যতিব্যস্ত, তাদের নিজেদের মধ্যে গোলমালও মাঝে-মধ্যে হয়ে দাঁড়ায় মাথাব্যথার কারণ। গোলাগুলিতে এলাকা অশান্ত হওয়ার পাশাপাশি বিপাকে পড়েন পেটের দায়ে মাফিয়াদের হয়ে বালি কাটতে যাওয়া অসংখ্য শ্রমিকেরা।

রানা সেনগুপ্ত
বর্ধমান শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৪ ০৬:৪৭
Share: Save:

বালি মাফিয়াদের দাপটে সাধারণ মানুষ যেমন ব্যতিব্যস্ত, তাদের নিজেদের মধ্যে গোলমালও মাঝে-মধ্যে হয়ে দাঁড়ায় মাথাব্যথার কারণ। গোলাগুলিতে এলাকা অশান্ত হওয়ার পাশাপাশি বিপাকে পড়েন পেটের দায়ে মাফিয়াদের হয়ে বালি কাটতে যাওয়া অসংখ্য শ্রমিকেরা।

কিছু দিন আগেই ইদিলপুরে দু’দল মাফিয়ার দ্বন্দ্বে গুলিবিদ্ধ হয় এরকম পাঁচ জন শ্রমিক। বড় মাফিয়াদের খোঁজে তল্লাশিতে যায় পুলিশ। কিন্তু তার আগেই মাফিয়াদের কাছে পৌঁছে যায় সেই খবর। বেশির ভাগ সময়েই পুলিশ ফেরে খালি হাতে।

এলাকায় বালি মাফিয়াদের দাপট এতটাই যে, মুখ খুলতে ভয় পান এলাকার মানুষজন। মাফিয়াদের মধ্যে আবার রয়েছে গোষ্ঠী। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এখন জেলার গ্রামীণ এলাকায় যে মাফিয়ার দাপট সব চেয়ে বেশি তার নাম রাজীব। এক সময়ে মোটরবাইক চুরি চক্রের পাণ্ডা ছিল এই রাজীব। এ ছাড়াও গদি থেকে টাকা তুলে রায়না, খণ্ডঘোষের দিকে ফেরা চালকল মালিকদের থেকে ছিনতাইয়েও তার মদত ছিল বলে অভিযোগ। ধরা পড়া ছিনতাইকারীদের থেকেই তা জানা গিয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর।

তবে পরপর এরকম কয়েক জন ছিনতাইকারী ধরা পড়ার পরে রাজীব মোটরবাইক চুরি বা ছিনতাইয়ের চক্র চালানো বন্ধ করে অবৈধ বালি খাদান ব্যবসায় মন দেয় বলে জেনেছে পুলিশ। সে কারণে আগের তুলনায় মোটরবাইক চুরি কমেছে বলেও মনে করছে জেলা পুলিশ।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্ধমান, খণ্ডঘোষ বা রায়নার অন্তত ৭০টি অবৈধ বালি খাদানের যারা চালায়, তাদের থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা নেয় রাজীব। তার বিনিময়ে ওই বালি চোরদের ‘নিরাপত্তা’ দেয় সে। বিরোধী পক্ষের বালি চোরেদের উপরে হামলা চালিয়ে রাজীব তাদের ভয়ও দেখায়, যাতে তারা ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে। ইদিলপুরের ঘটনার পিছনেও এই কারণই ছিল বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।

পুলিশ জানায়, রাজীবের একটি মোটরবাইক বাহিনী রয়েছে। ৩০-৪০টি মোটরবাইকে করে ঝটিতি হামলা চালিয়ে পুলিশ পৌঁছনোর আগেই এলাকা ছেড়ে পালায় এই বাহিনী। ওই খাদানে আর বালি তুলতে সাহস করে না শ্রমিকেরা, জানিয়েছে পুলিশ।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজীবের বাড়ি রায়নার কামালপুর খালপাড়ে। দামোদর ঘেঁষা সেই বাড়িতে বারবার অভিযান চালিয়েছে বর্ধমান, রায়না ও খণ্ডঘোষের পুলিশ। খণ্ডঘোষের এক প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিকের কথায়, “এক দিন পাকা খবর ছিল, রাজীব বাড়িতে রয়েছে। গভীর রাতে আমরা বাড়ি ঘিরে ফেললাম। কিন্তু ভিতরে ঢুকে প্রচুর তল্লাশি চালিয়েও ওকে পেলাম না। শেষে দেখি, প্রায় ভিতের কাছে একটি শিকবিহীন জানালা রয়েছে। সেটি আগে বন্ধ ছিল। এখন খোলা। তা দিয়ে গলেই পালিয়েছিল রাজীব।”

তার পরেও কয়েক বার ওই বাড়িতে হানা দিয়েছে খণ্ডঘোষ থানার পুলিশ। কিন্তু প্রতি বারই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে এই মাফিয়া। পরে পুলিশ জেনেছে, রাজীবের একটি অল্পবয়সীদের নিয়ে গড়া দল রয়েছে। তাদের কাজ, পুলিশ বা অপরিচিত কাউকে ওই বাড়ির দিকে যেতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে দেওয়া। খবর পেয়ে গা ঢাকা দিত রাজীব। আর পুলিশি অভিযানের পাকা খবর দিতে পারলে ওই ছেলেরা পেয়ে যেত ইনাম।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রাজীবকে না পেয়ে শেষে এক বার খালপাড়ের ওই বাড়িতে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সম্প্রতি সেখানে অভিযানে গিয়ে বর্ধমান থানার এক এসআই দেখেন, বাড়িতে দিব্যি বাস করছে রাজীবের পরিবার। বাড়ির উঠোনে ছাড়া রয়েছে এক জোড়া অ্যালসেশিয়ান। গাছের পাতা নড়লেও তারা ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। ওই এসআইয়ের কথায়, “আমি রাজীবের খোঁজে বাড়ির পাঁচিল টপকাতে উঠেছিলাম। কিন্তু যে ভাবে ওই কুকুর তেড়ে এল, আর নীচে নামার সাহস পাইনি। পাঁচিলে বসে বারবার বলি, কুকুর বাঁধুন। পুলিশ এসেছে। তল্লাশি হবে। এর পরে আর রাজীব বাড়িতে থাকে?”

এই মাফিয়া-রাজে খণ্ডঘোষ, রায়না, বর্ধমানে বালি খাদান নিয়ে অশান্তি বাড়ছে। অবিলম্বে রাজীব ও অন্য বালি মাফিয়াদের ধরা না গেলে তারা রাতের ঘুম কেড়ে নেবে, মেনে নেন জেলা পুলিশের এক কর্তা। তিনি বলেন, “রাজীবের হাত যার মাথায় রয়েছে, সেই বালি মাফিয়ারা যা খুশি করতে পারেএমন একটা বার্তা রটে যাচ্ছে। ফলে, অদূর ভবিষ্যতে বালি খাদানগুলিকে কেন্দ্র করে খুনজখম শুরু হয়ে যাবে।”

গত আড়াই বছরে যেখানে জেলায় বেশ কয়েক জন কয়লা মাফিয়াকে গ্রেফতার করা গিয়েছে, সেখানে রাজীবকে ধরা যাচ্ছে না কেন? এসডিপিও (বর্ধমান) অম্লানকুসুম ঘোষ বলেন, “রাজীব ওই খালপাড়ের বাড়িতে আর থাকে না। সে কোথাও লুকিয়ে রয়েছে। আমরা খবর পাচ্ছি না। তাকে ধরার চেষ্টা চলছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rana sengupta sand mafia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE