Advertisement
২০ মে ২০২৪

মূর্তির গায়ে সোনার গুঁড়ো ছড়িয়ে প্রতারণা

আলো-আধাঁরি ঘরে পিতলের পুরনো মূর্তি ঘষা চলছে। তার মধ্যেই খরিদ্দারের চোখে ধুলো দিয়ে দু আঙুলের ফাঁক দিয়ে মূর্তির গা বেয়ে কেউ ছড়িয়ে দিচ্ছে সোনার গুঁড়ো। ক্রেতা সেই গুঁড়ো নিয়ে সোজা দোকানে গিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছেন যে মূর্তিটি সোনারই। তারপর নগদ টাকায় তা কিনে হাঁটা দিলেই কেল্লা ফতে। সম্প্রতি একটি খুনের মামলার কিনারা করতে গিয়ে কালনা মহকুমা জুড়ে এমনই এক মূর্তি প্রতারণা চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ।

বাসনের দোকান থেকে কেনা এ ধরনের মূর্তি দিয়েও হয় প্রতারণা। —নিজস্ব চিত্র।

বাসনের দোকান থেকে কেনা এ ধরনের মূর্তি দিয়েও হয় প্রতারণা। —নিজস্ব চিত্র।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য
পূর্বস্থলী শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:২২
Share: Save:

আলো-আধাঁরি ঘরে পিতলের পুরনো মূর্তি ঘষা চলছে। তার মধ্যেই খরিদ্দারের চোখে ধুলো দিয়ে দু আঙুলের ফাঁক দিয়ে মূর্তির গা বেয়ে কেউ ছড়িয়ে দিচ্ছে সোনার গুঁড়ো। ক্রেতা সেই গুঁড়ো নিয়ে সোজা দোকানে গিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছেন যে মূর্তিটি সোনারই। তারপর নগদ টাকায় তা কিনে হাঁটা দিলেই কেল্লা ফতে।

সম্প্রতি একটি খুনের মামলার কিনারা করতে গিয়ে কালনা মহকুমা জুড়ে এমনই এক মূর্তি প্রতারণা চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, রীতিমতো এজেন্ট লাগিয়ে খরিদ্দার খোঁজে এই প্রতারকেরা। খরিদ্দার মূর্তি পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেও বুক ঠুকে রাজি হয়ে যায়। তারপরেই কম আলোর ঘরে মূর্তির গুঁড়ো ক্রেতাকে দিতে দেয় দেখায় আসল কেরামতি। অনায়াসে পিতলের মূর্তির গা বেয়ে সোনার গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয়। ক্রেতাও তা পরীক্ষা করিয়ে সোনার ভেবে পা দেয় প্রতারকদের ফাঁদে।

পুলিশ সূত্রের খবর, ১৯ অক্টোবর সভায় যাচ্ছি বলে বাড়ি থেকে মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়েছিলেন পূর্বস্থলী ২ ব্লকের মাজিদা এলাকার খাব্বার আলি শেখ। আর ফেরেননি। পরের দিন কাছাকাছি তামাঘাটায় ভাগীরথীর ঘাট থেকে বস্তাবন্দি দেহ মেলে তাঁর। কিছুটা দূরে বড়েয়া এলাকায় মেলে খাব্বারের মোটরবাইকটিও। পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে, ওই রাতে খাব্বার ও তাঁর দুই বন্ধুকে মুখ-চোখ বেঁধে অপহরণের চেষ্টা করে দুষ্কৃতীরা। ওই দুই বন্ধু কোনওরকমে পালাতে পারলেও খাব্বারকে অপহরণ করে ওই দুষ্কৃতীরা। এরপরই আমিন শেখ এবং জডা শেখ নামে ওই দু’জনকে জেরা করে পুলিশ। জেরায় খাব্বারকে খুনের কথা কবুল করে তারা। খুনের কারণ খুঁজতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, পিতলের মূর্তিকে সোনার বলে বিক্রির প্রতারণায় যুক্ত ছিল ওই তিন জন। সম্প্রতি এক ব্যবসায়ীকে ৭০ হাজারেরও বেশি দামে একটা মূর্তি বিক্রি করে তারা। সে রাতে ভাগ-বাঁটোয়ারার টাকা নিয়ে গণ্ডগোল বেধেছিল খাব্বারের সঙ্গে ওই দু’জনের। তার জেরেই খুনের ঘটনা ঘটে। পুলিশ আরও জানতে পারে, এই তিন জনই নয় মূর্তি পাচার চক্রে জড়িয়ে রয়েছে আরও চার জন। তল্লাশ না মিললেও তাদের ডেরা থেকে পিতলের মূর্তি পেয়েছে পুলিশ।

জানা গিয়েছে, নবদ্বীপ ও তার আশপাশের এলাকা থেকে ওই প্রতারকেরা পিতলের দেবদেবীর মূর্তি কিনত। তারপরে সেই মূর্তিকে প্রাচীন প্রমাণের জন্য লিকার চা অথবা তুঁতে ও কস্টিক সোডা মেশানো জলে ঘণ্টা আটেক ডুবিয়ে রাখা হত। এতে মূর্তির গায়ে একটা কালচে আস্তরণ পড়ে যায়, যা দেখে মনে হয় দীর্ঘদিন সিন্দুক অথবা মাটির তলায় মূর্তিটি রাখা ছিল। এই মূর্তি চোরদের কিছু এজেন্ট থাকে। যারা হাট-বাজার, চায়ের দোকান-সহ নানা জায়গায় খরিদ্দারের কাছে পৌঁছে দেয় ওই মূর্তি। প্রথমে হাতে নিয়ে মূর্তি দেখে দরদাম করতে পারেন ক্রেতা। মূর্তির গা ঘষে মেলা সোনার গুঁড়ো যাচাই করারও সুযোগ থাকে। পূর্বস্থলী থানার এক আধিকারিক বলেন, “চোখের নিমেষে হাত সাফাই করে প্রতারকেরা যে গুঁড়ো ক্রেতার হাতে দেয়, তা খাঁটি সোনার হওয়ায় অনেকেই ঝোঁকে একাধিক কেনেন। পরে প্রতারিত হয়েছেন বুঝতে পেরেও দুষ্কৃতীদের ভয়ে অনেকেই অভিযোগ জানাতে আসেন না। যাঁরা আসেন সেই মতো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”

মহকুমা পুলিশের অবশ্য দাবি, এ ধরনের প্রতারণা নতুন নয়। আগেও স্কুলের শিক্ষক থেকে রেলের আধিকারিক অনেকেই এ ধরনের প্রতারণার অভিযোগ করেছেন। তবে ২০১২ সালের পরে বছরখানেক এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি বলে পুলিশের দাবি। সে বছর মাজিদা এলাকার কয়েকজন যুবক রাজমিস্ত্রির কাজ করতে কেরলে যান। অভিযোগ, সেখানে এক নেপালি গাড়ির চালককে পুরনো সোনার মূর্তি বলে পিতলের মূর্তি বিক্রি করে তারা। সেই চালক নিজের পরিচিত কয়েকজনকে মূর্তির কথা বলে। তারাই কিনতে আগ্রহী হয়। এরপরেই ইচ্ছুক ক্রেতাদের মাজিদা এলাকায় ডেকে পাঠায় প্রতারকেরা। লক্ষাধিক টাকা সঙ্গে নিয়ে আসা দুই মহিলা-সহ চার নেপালের বাসিন্দাকে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে লুঠ করা হয় বলেও অভিযোগ। কাছাকাছি একটি স্কুলে গিয়ে কোনওরকমে প্রাণে বাঁচে তারা। এরপরেই কালনা, মন্তেশ্বর -হ নানা জায়গায় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে পুলিশ। বছর দুয়েক গুটিয়ে থাকার পরে এখন আবার ওই চক্রটি মহকুমা জুড়ে সক্রিয় হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। মাস ছয়েক আগে এক ব্যবসায়ীর অভিযোগ পেয়ে কালনা থানার পুলিশ বুলবুলিতলা থেকে এক যুবককে গ্রেফতার করে। তাকে জেরা করে নিভুজিবাজার এবং কপ্পুরডাঙা এলাকা থেকেও দু’জনকে ধরে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে একটি পিতলের মূর্তি মেলে। সম্প্রতি মন্তেশ্বরের এক ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন, সোনায় কয়েনের লোভ দেখিয়ে তার কাছ থেকে কয়েক হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে পুলিশ। অভিযোগ পেয়ে পূর্বস্থলী ১ ব্লকের ঘোলা এলাকা থেকে ফিরোজ শেখ নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ।

কালনার মহকুমাশাসক সব্যসাচী ঘোষ বলেন, “সাধারণ মানুষকে আরও সতর্ক হতে হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kedarnath bhattacharya purbasthali fraud
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE