তাঁত শিল্পীদের জন্য এ বার ব্যাঙ্ক চালু হচ্ছে জেলায়। পূর্বস্থলী ১ ব্লকের শ্রীরামপুর পঞ্চায়েতে এক বেসরকারি ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে জমিও দিচ্ছে তন্তুজ। সংস্থার চেয়ারম্যান তথা রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ জানান, ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা পাকা। কোন কোন এলাকার তাঁতিদের ওই ব্যাঙ্ক থেকে পরিষেবা দেওয়া হবে তাও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। মাস দু’য়েকের মধ্যে ব্যাঙ্কটি খোলারও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। মন্ত্রীর দাবি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট চালু হলে তাঁতে দুর্নীতি অনেকটাই কমবে। ভবিষ্যতে ব্যাঙ্কের সংখ্যা বাড়ানোরও ভাবনা রয়েছে সরকারের।
রাজ্যে হস্তচালিত তাঁত শিল্পের তিনটে অঞ্চল রয়েছে- বর্ধমান, প্রেসিডেন্সি ও উত্তরাঞ্চল। বর্ধমান, বাঁকুড়া, নদিয়া, পুরুলিয়া, হুগলি, মুর্শিদাবাদ ও মালদহ জেলা ওই তিন জোনের মধ্যে পড়ে। হস্তচালিত তাঁত দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, তিন দশক আগে গ্রামেগঞ্জে তাঁতশিল্পের নানা সমস্যা মেটাতে তৈরি হত সমবায়। মূলত দু’ধরনের সমবায় হয় এ রাজ্যে। এক ধরনের সমবায়ে যাঁদের তাঁত রয়েছে তাঁদের সুতো দেওয়া হয়। অন্য দিকে, তাঁতবিহীন তন্তুবায় সমিতিগুলোয় তাঁত যন্ত্র, সুতো, রঙ করার ব্যবস্থা সবই থাকে। সমবায়গুলি সাধারণত তাঁতিদের তাঁত বোনার মজুরি দেয় এবং তৈরি হওয়া পণ্য তন্তুজ, তন্তুশ্রী, মঞ্জুষার মতো সংস্থাগুলোকে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বেশিরভাগ সমবায় বন্ধ হয়ে যায়। বহু সমবায় ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সংস্থায় পরিণত হয়। বর্তমানে এ রাজ্যে শ’পাঁচেক মতো সমবায় চালু রয়েছে। সমবায়গুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, সমবায়গুলি প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা সরকারি বরাদ্দ পেলেও তার ছিঁটেফোটা গরিব তাঁতিদের কাছে পৌঁছয় না। তাঁতে দুর্নীতির কথা স্বীকার করে স্বপনবাবু বলেন, “বহু সমবায় সমিতিতে ভুয়ো সদস্যের তালিকা থাকত। ফলে তাদের নামে সরকারি নানা সুযোগ সুবিধা মিলত। অনেক সময় বছরের শেষে মিষ্টির প্যাকেট বা উপহার দিয়েও বহু সমবায় সমিতিতে সদস্যদের দিয়ে খাতায় সই করিয়ে নেওয়া হত। তবে বর্তমান সরকারি এ বিষয়ে সতর্ক। দুনীর্তি বন্ধ করে সরকারি টাকা যাতে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয় তা নিশ্চিত করতে ব্যাঙ্ক খোলা-সহ নানা পদক্ষেপ করা হচ্ছে।”
হস্তচালিত তাঁত দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, শ্রীরামপুর এলাকায় তন্তুজের প্রোকিওরমেন্ট কেন্দ্রটি যেখানে রয়েছে সেই চত্বরেই কিছুটা জমি বরাদ্দ করা হয়েছে ব্যাঙ্কটির জন্য। ইতিমধ্যে ব্যাঙ্কটির সল্টলেক শাখার একটি দল জায়গাটি ঘুরেও গিয়েছে। পূর্বস্থলী ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ মল্লিক জানান, তন্তুজের প্রোকিওরমেন্ট কেন্দ্রের সামনে দফতরের একটি অফিস ঘর খোলা হয়েছে। সেই ঘরটিই আপাতত ব্যবহার করার জন্য ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে। পরে নিজস্ব ভবন হয়ে গেলে ঘরটি ছেড়ে দেবে ব্যাঙ্ক। মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, “ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যা কথা হয়েছে তাতে তাঁতিদের জিরো ব্যালেন্স অ্যাকাউন্ট খোলা হবে। বর্ধমান ও নদিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকার তাঁতিরা এই পরিষেবা পাবেন। ব্যাঙ্ক চালু হলে ধুতি, লুঙ্গি, শাড়ি, চাদর কেনার যে টাকা মজুরি বাবদ দেওয়া হয় তা তাঁতিদের নিজস্ব অ্যাকাউন্টে চলে যাবে। এছাড়া বিভিন্ন মেলায় তাঁত পণ্য বিক্রির উপর যে সরকারি উৎসাহ ভাতা দেওয়া হয় সেই টাকাও অ্যাকাউন্টে সরাসরি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।” হস্তচালিত তাঁত দফতররে অতিরিক্ত ডিরেক্টর গোপাল বসাক জানান, সরকারি উৎসাহ ভাতা-সহ অন্য অর্থের ক্ষেত্রে বর্তমানে কলকাতা থেকে চেক দেওয়া হয়। সেই চেক সমবায় সমিতি-সহ যে কোনও জায়গায় ভাঙাতে সময় লাগে। এলাকায় ব্যাঙ্ক হলে সরাসরি অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো যাবে তাঁতিদের। হস্তচালিত তাঁত দফতরের এক আধিকারিক জানান, সমবায় ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা খারাপ হওয়ায় সরকারি ভাবে নতুন করে তাঁত সমবায় তৈরির ব্যাপারে বর্তমান সরকার বেশ কড়া। বন্ধ হয়ে যাওয়া সমবায়গুলি খোলার ক্ষেত্রেও যে প্যাকেজ রয়েছে তার শর্ত পূরণ করা বেশ কঠিন। এই পরিস্থিতিতে সমবায় আইনে নথিভুক্ত ক্লাস্টারগুলিকে অর্থ সাহায্য করছে সরকার। পাশাপাশি বেশ কিছু নতুন ক্লাস্টারকে অনুমোদনও দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি পূর্বস্থলী ১ ব্লকের সমুদ্রগড় গণেশচন্দ্র কর্মকার তাঁত হাটে হস্তচালিত তাঁত দফতর একটি সভা করে। সেখানে সাতটি নতুন ক্লাস্টারের হাতে প্রায় দু’কোটি টাকা তুলে দেওয়া হয়। ক্লাস্টারগুলি সেই অর্থ অফিস ঘর তৈরি, সদস্যদের জন্য তাঁতযন্ত্র কেনা-সহ নানা কাজে বা পরিকাঠামো উন্নয়নে কাজে লাগাবে বলে ওই দফতরের কর্তারা জানান। গোপালবাবু জানান, তাদের পরিকল্পনা রয়েছে প্রথম দফায় ৩৫টি ক্লাস্টারকে সাহায্য করা।
ওই সভায় কোন ক্লাস্টার কোন খাতে কত টাকা পাচ্ছে, তা সদস্যদের বিস্তারিত জানান মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। সদস্যদের তালিকা প্রকাশ্যে টাঙানোরও নির্দেশ দেন ক্লাস্টার সম্পাদককে। আধিকারিকদের নির্দেশ দেন সরকারি অর্থ কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে তা সরেজমিনে তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়ার এবং কোনও গড়িমসি হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার। স্বপনবাবু বলেন, “আগে সমবায় কীভাবে, কত টাকা পেত তা সাধারণ তাঁতিদের জানার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। তবে এখন এ ব্যবস্থার বদল হয়েছে। সভা ডেকে বলে দেওয়া হচ্ছে, তাঁতিদের কী প্রাপ্য। পাশাপাশি ধুতি, শাড়ি প্রভৃতি আলাদা পণ্যে সুতো যাচাই করে দেখে নেওয়া হচ্ছে।”